দেশে অপমৃত্যু মামলার জোরালো তদন্ত হয় না

|

দেশে প্রতিদিন ১৫ ধরনের অপমৃত্যু বা অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। বেসরকারি সংস্থার কাছেও তথ্য নেই। তবে পরিসংখ্যানে উঠে আসা তথ্য বেশ উদ্বেগজনক।

কোনো কোনো অপমৃত্যুর ঘটনায় মামলা বা জিডি হলেও জোরালো তদন্ত হয় না। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কর্মকর্তারা বলছেন, অপমৃত্যুর ঘটনাকে কোনোভাবে গুরুত্বহীন বা কম গুরুত্বপূর্ণ ভাবা যাবে না। এতে অপরাধী পার পেয়ে যেতে পারে।

অপরাধ, সমাজ ও মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিটি অপমৃত্যু ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে এর নেপথ্য কারণ নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি সতর্ক হলে কিছু অপমৃত্যু এড়ানো সম্ভব। এসব বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে হবে। গলায় ফাঁস দিয়ে কিংবা বিষপানে আত্মহত্যা, পানিতে ডুবে মৃত্যু, মাটি বা পাহাড়চাপা পড়ে মৃত্যু, বজ্রপাতে মৃত্যু, বন্যপ্রাণী বা পশুর আঘাতে মৃত্যু, বজ্রপাতে মৃত্যু, আগুনে পুড়ে মৃত্যু, মেশিনারিজ চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যু, ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটে মৃত্যু, উঁচু গাছ বা ছাদ থেকে পড়ে মৃত্যু অথবা সন্দেহজনক মৃত্যু হলে থানায় অপমৃত্যু হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়। অভিযোগ, এক্ষেত্রে কোনো তদন্ত হয় না। এসব অপমৃত্যুর নেপথ্য কারণও জানা যায় না। এ সুযোগে পরিকল্পিতভাবে কাউকে মেরে তা অপমৃত্যু হিসেবে চালিয়ে পার পেয়ে যায় অপরাধীরা।

পুলিশ সদর দফতরের এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশে ৮৭ হাজার ৬১৯ জনের অপমৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৫৪ হাজার ৩৯ জন আত্মহত্যা করেছে। আর অন্য সব কারণে ৩৩ হাজার ৫৮০ জনের অপমৃত্যু হয়েছে ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, দেশে প্রতি বছর ১০ থেকে ১১ হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু আত্মহত্যা করে। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা বেশি। এছাড়া অগ্নিকাণ্ড, বিদ্যুৎস্পৃষ্টসহ বিভিন্ন কারণে বছরে ১০ লাখের বেশি লোক অগ্নিদগ্ধ হয়। যাদের মধ্যে দুই হাজারের বেশি লোক মারা যায়।

পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনাও উদ্বেগজনক। এতে প্রায় ১৩ হাজার শিশু মারা যায়। এদের বয়স এক থেকে ১৭ বছর। এছাড়া সাপের কামড়ে বছরে ছয় হাজারের বেশি লোক মারা যায়। আর প্রতি বছর বজ পাতে দুই থেকে তিন শতাধিক মানুষ মারা যায়।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একাধিক থানার ওসি জানান, মৃত্যু বা খুনের প্রকৃত কারণ আপাততভাবে নির্ণয় করা সম্ভব না হলে অপমৃত্যুর মামলা করা হয়। ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ১৭৪ ধারা এবং পিআরবি নিয়ম ২৯৯ অনুযায়ী আত্মহত্যা কিংবা সন্দেহজনক মৃত্যুর ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ১৭৪ ধারায় অপমৃত্যুর (ইউডি) মামলা হয়। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর পুলিশ মামলাটি তদন্ত করে আদালতে পাঠায়। আদালত সবকিছু দেখে যথাযথ নির্দেশ দেন। অপমৃত্যুর মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার কোনো সুযোগ নেই।

তারা বলেন, অপমৃত্যু মামলাকে নিয়মিত মামলার মতো গুরুত্বসহ তদন্ত করা হয়। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে পরিকল্পিত হত্যার প্রমাণ পাওয়া গেলে মামলা সচল করা হয়। নেতিবাচক কিছু না পেলে মামলাটি নিষ্ক্রিয় করা হয়।

তবে পুলিশের অপর একটি সূত্র জানায়, অপমৃত্যু মামলা নেয়া পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে। এরপর আর কারও কোনো গরজ থাকে না। জানা গেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে করা অপমৃত্যু মামলা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। এতে অনেক সময় প্রকৃত ঘটনা আড়াল হয়ে যায়। তবে এমন ধরনের ১০টি ঘটনার পুনঃতদন্ত করেছে পিবিআই। এগুলো প্রথমে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়া হলেও পিবিআইর তদন্তে হত্যার প্রমাণ বেরিয়ে আসে। ঘাতকদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হয়।

পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, অপমৃত্যুর ঘটনাকে কোনোভাবেই গুরুত্বহীন বা কম গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয় না। এতে অপরাধী পার পেয়ে যেতে পারে।

তিনি বলেন, প্রতিটি অপমৃত্যুর ঘটনারও যথাযথ তদন্ত করা উচিত। এছাড়া কোনো অপমৃত্যুর ঘটনা রহস্যজনক মনে হলে তা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা না করে তদন্ত শুরু করা উচিত। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন যে সময়ের মধ্যে আসবে সেই সময়ে মামলার গুরুত্ব অনেকটাই কমে যাবে, নষ্ট হয়ে যাবে আলামত। তিনি বলেন, শুধু ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের দিকে না তাকিয়ে অপমৃত্যুর ঘটনায় তদন্ত চালিয়ে যাওয়া উচিত।

আত্মহত্যা : জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশে প্রতিদিন গড়ে ২৮ জন আত্মহত্যা করে। বেশির ভাগ ২১ থেকে ৩০ বছরের নারী।

২০১৭ সালের পুলিশ প্রতিবেদন অনুসারে দেশে ১১ হাজার ৯৫ জন আত্মহত্যা করে। ২০১৮ সালে ১১ হাজার লোক আত্মহত্যা করেছে। আর চলতি বছরের এ পর্যন্ত ছয় হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন বিষপান কিংবা গলায় রশি দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করা পাঁচ- ছয়জন আসে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, আত্মহত্যার ক্ল্যাসিকাল কারণগুলোর বাইরে বাংলাদেশে নতুন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। মানবিক ও সামাজিক সম্পর্কের নতুন ধারা এবং মাত্রা আমাদের সমাজে প্রবেশ করছে। অন্য সমাজে যা স্বাভাবিক আমাদের এখানে তা স্বাভাবিক নয়। ফলে এক ধরনের মানসিক দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে। যা কাউকে কাউকে গভীর হতাশায় নিমজ্জিত করে আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করছে। তিনি বলেন, সামাজিক সংহতি নষ্ট হলে মানুষ বিচ্ছিন্নতায় ভোগে। বিচ্ছিন্নতা থেকে চরম হতাশার সৃষ্টি হয়। এ কারণেই শেয়ারবাজারে পুঁজি হারিয়ে কেউ কেউ আত্মহত্যা করেন।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম বলেন- বৈষম্য, বঞ্চনা, বিভ্রান্তি, হতাশা এবং না পাওয়ার কারণে মানুষ আত্মহত্যা করে। যেখানে সমাজের ভারসাম্য কম, অগ্রগতির সুফল সবাই সমানভাবে পায় না এবং বিভক্তি বেশি সেখানে এ প্রবণতাও বেশি। তিনি বলেন, আত্মহত্যা রুখতে হলে সচেতনতার বিকল্প নেই। সচেতনতা বাড়াতে হবে। সুস্থ মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। এতে আত্মহত্যার মাত্রা কমে আসবে। একই কথা বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাসুদা এম রশিদ চৌধুরী।

আগুনে পুড়ে মৃত্যু : প্রতি বছর আগুনে পুড়ে মারা যাওয়ার ঘটনা বাড়ছে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের পরিসংখ্যানের তথ্যের চেয়ে আগুনে পোড়ার প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ। যেসব ঘটনার অগ্নিনির্বাপণে ফায়ার সার্ভিস যায় সেখানকার পরিসংখ্যানটা তাদের কাছে থাকে। এছাড়া বিদ্যুৎস্পৃষ্ট, সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, গ্যাসের আগুনে দগ্ধসহ বিভিন্নভাবে মানুষ দগ্ধ হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্তলাল সেন যুগান্তরকে বলেন, প্রতি বছর ছয় লাখেরও বেশি মানুষ আগুনে দগ্ধ হয়। আর আক্রান্তদের মধ্যে বছরে দুই হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, ব্যবহারকারীদের সচেতনতা, ফায়ার সার্ভিসের পরামর্শ, পাইপলাইন ও সিলিন্ডার গ্যাসের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে এমন দুর্ঘটনার সংখ্যা কমে আসবে।

বজ্রপাতে প্রাণহানি : দেশে বজ্রপাতে প্রতি বছর গড়ে ২৫০ জনের বেশি মারা যান। এ মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি। প্রতি বছর মার্চ থেকে বজ্রপাত শুরু হয়। চলতি বছর বজ পাতে মৃত্যুর সংখ্যা ৭০ ছাড়িয়েছে। কিন্তু বাংলদেশে বজ পাত নিয়ে কোনো গবেষণা এবং এ থেকে রক্ষার কার্যকর জাতীয় কোনো কার্যক্রম নেই।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর, বুয়েট, দুর্যোগ ফোরাম, গণমাধ্যমের তথ্য ও একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হিসাব মতে, ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বজ পাতে দুই হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে।

দুর্যোগ ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী- ২০১৮ সালে ২৯৭ জন, ২০১৭ সালে ৩০৬, ২০১৬ সালে ৩৫১, ২০১৫ সালে ২৭৪, ২০১৪ সালে ২১০, ২০১৩ সালে ২৮৫, ২০১২ সালে ৩০১, ২০১১ সালে ১৭৯ এবং ২০১০ সালে ১২৩ জন বজ পাতে মারা গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বজ পাতে প্রাণহানি কমাতে জনসচেতনতা সবচেয়ে জরুরি। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তড়িৎ ও ইলেকট্রিক্যাল কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. শহীদুল ইসলাম খান বলেন, একেকটি বজ পাতের সময় প্রায় ৬০০ মেগা ভোল্ট বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। তিনি বলেন, একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য মাত্র ১০০ ভোল্ট বিদ্যুৎই যথেষ্ট। বজ পাতে মাত্র এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে একজন মানুষের মৃত্যু হয়। বজ পাতের সময় বৈদ্যুতিক ঝরনায় গোসল করা বিপজ্জনক জানিয়ে তিনি বলেন, খোলা মাঠে থাকাকালে খুব কাছে বজ পাত হলে ধাতব বস্তু যেমন- আংটি, চাবি, কাস্তে, কোদাল, মোবাইল ফোনসেট ইত্যাদি কমপক্ষে ৬০ ফুট দূরে রাখতে হয়।

পানিতে ডুবে মৃত্যু : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপে বলা হয়, দেশে পানিতে ডুবে প্রতিদিন গড়ে ৪০ জন শিশু মারা যায়। এতে এক থেকে ১৭ বছর বয়সীরা বেশি মারা যায়। এতে প্রতি বছর ১৪ হাজারের মতো শিশু মারা যায়।

তবে কোনো সংস্থা পানিতে ডুবে মৃত্যুর পরিসংখ্যান লিপিবদ্ধ করে না। এ বছরের শুরু থেকে আইন ও সালিশ কেন্দ্র পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুর বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছে।

সংস্থা জানায়, নয়টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের তথ্য দিয়ে পানিতে ডুবে মৃত্যুর পরিসংখ্যান তৈরি করা হচ্ছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব মতে, পানিতে ডুবে এ বছরের জানুয়ারিতে দুটি শিশু, ফেব্রুয়ারিতে ১৬, মার্চে ৮, এপ্রিলে ২৪, মে মাসে ২০, জুনে ৩০টি শিশু মারা গেছে।

সাপের কামড়ে মৃত্যু : দেশে সাপের কামড়ে মৃত্যুর পরিসংখ্যান কোনো সংস্থার কাছে নেই। তবে ২০০৯ সালে বাংলাদেশে প্রথম সর্প দংশন বিষয়ে জাতীয় জরিপ হয়। জরিপে উঠে আসে বছরে দেশে ছয় লাখ মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হয়। এতে ৬০৪১ জন মারা যায়। আর দংশনের শিকার ৮৬ ভাগ মানুষ ওঝার কাছে যায়।

জরিপে অংশ নেয়া শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. রিদওয়া উর রহমান বলেন, হাসপাতালে যাওয়ার আগেই সাপে কামড়ানো অর্ধেক রোগী মারা যায়। কমিউনিটি হাসপাতালে সাপের কামড়ের চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকলে প্রাণহানি অনেক কমে আসবে।
সূত্র: যুগান্তর


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply