ইয়াবা পাচারের বড় রুট রেলপথ

|

রেলপথে চোরাচালান নতুন নয়। তবে এখন প্রাণঘাতী মাদক ইয়াবা পাচারের বড় রুট হিসেবে রেল ব্যবহৃত হচ্ছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা সতর্কাবস্থায় থাকলেও রেলপথে মাদক প্রতিরোধে সফলতা আসছে না।

শরীরের স্পর্শকাতর স্থান এমনকি পেটের ভেতরে রেখে নারী বা পুরুষরা ইয়াবা পাচার করছে। ট্রেনের শত শত যাত্রীর মধ্যে চোরাকারবারিরা সহজেই নিজেদের আড়াল করে রাখছে। যাত্রীবেশে ইয়াবা ব্যবসার এমন কৌশলে খোদ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ উদ্বেগ প্রকাশ করলেও অধিকাংশ ট্রেনে পুলিশ থাকে না। আবার কোনো স্টেশনেই স্ক্যানার মেশিন নেই। মালবাহী ট্রেনে কোনো নজরদারিই নেই।

শুধু গোপন সংবাদের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম ও কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে প্রতি মাসে গড়ে ১১ থেকে ১২ হাজার ইয়াবা আটক করা হচ্ছে। ট্রেনে নজরদারি ও স্টেশনগুলোতে ন্যূনতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় ৯০ শতাংশ অপরাধী ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। ফলে শরীরের স্পর্শকাতর স্থান বা পেটের ভেতর কিংবা ব্যাগ, লাগেজে করে ইয়াবা বহন করা হলেও তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। জানা গেছে, ইয়াবা চালানের সঙ্গে তরুণী থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের নারীরা সম্পৃক্ত। কিন্তু ট্রেনে কোনো নারী পুলিশ না থাকায় তাদের চ্যালেঞ্জ কিংবা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ কিংবা তল্লাশি করা সম্ভব হয় না।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, হেরোইন, ইয়াবাসহ বিভিন্ন পণ্য চোরাচালানের নিরাপদ বাহন হিসেবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে লোকাল ও মেইল ট্রেন। এসব ট্রেনে কোনো পুলিশ থাকে না। নির্ধারিত সিটের তুলনায় পাঁচ থেকে ছয় গুণ যাত্রী চলাচল করে এসব ট্রেনে। চোরাকারবারিরা যাত্রীবেশে এসব ট্রেনে যাতায়াত করছে। আন্তঃনগর ট্রেনগুলোতে বিভিন্ন কৌশলে মাদক বহন করছে অপরাধীরা।

দেশের বিভিন্ন রুটে প্রতিদিন ৩৫৪টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করে। এর মধ্যে ৯২টি আন্তঃনগর ট্রেনের সবক’টিতে পুলিশ থাকে না। যেগুলোতে পুলিশ থাকে সেখানেও তাদের সংখ্যা হাতেগোনা। দুই হাজার থেকে ২২০০ যাত্রীর একেকটি ট্রেনে ৩-৪ জন পুলিশ থাকে। ফলে যাত্রীদের দেহ তল্লাশি কিংবা অবৈধ মালামাল শনাক্ত করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে টিকিট পরীক্ষার সময় টিটিইদের সঙ্গে পুলিশ সদস্যদের থাকতে দেখা যায়। শুধু গোপন সংবাদের ভিত্তিতেই সামান্য অবৈধ মালামাল, অপরাধী আটক করতে পারে রেলওয়ে পুলিশ।

মাঠপর্যায়ে কাজ করা পুলিশ সদস্যদের বক্তব্য- রেল পুলিশের জনবলের ঘাটতি রয়েছে। তল্লাশি চালানোর জন্য নেই কোনো আধুনিক যন্ত্র। ট্রেন থেকে হাজার হাজার যাত্রী নামে। সন্দেহ হলে পুলিশ কাউকে তল্লাশি করে। ৪-৫ বছর আগে বিভিন্ন ট্রেনে র‌্যাব ও লোকাল পুলিশের অভিযান থাকলেও বর্তমানে তাদের কোনো অভিযান নেই। রাজধানীতে আসা ট্রেনযাত্রীর প্রায় ৯৯ শতাংশ বিনা চেকিং কিংবা তল্লাশি ছাড়াই স্টেশন পার হচ্ছে।

সম্প্রতি কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে ১৫০০ ইয়াবাসহ রবিউল ইসলাম ও আবদুর রহিমকে আটক করা হয়। তাদের পেট থেকে এসব ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এর আগে মুক্তা নামে এক ইয়াবা পাচারকারীর স্পর্শকাতর স্থান থেকে ৭০০ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এছাড়া যাত্রীদের জুতা, মানিব্যাগ, মোবাইল ফোনসেট, টুপি, কলম, ফলমূল, বইসহ বিভিন্ন জিনিসের ভেতর ইয়াবা পাচার করা হচ্ছে। কয়েক মাস আগে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার রেলওয়ে স্টেশন এলাকা থেকে আট হাজার ৫৬৮টি ইয়াবাসহ দুই মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করে র‌্যাব। রেলপথে এ ইয়াবা চালান করার কথা ছিল।

রেলওয়ে পুলিশ সূত্র জানায়, রেলওয়ে স্টেশনগুলো নিরাপত্তার বলয়ে না আনা হলে এ পথে ইয়াবা কিংবা মাদক প্রতিরোধ করা কখনও সম্ভব নয়। তিন হাজার ২৮০ কিলোমিটার রেলপথে প্রতিদিন প্রায় সোয়া তিন লাখ যাত্রী চলাচল করে। যাত্রীদের নিরাপত্তায় দুই হাজার ৩৭৩ জন রেলওয়ে পুলিশ রয়েছে। যাত্রীদের নিরাপত্তায় ন্যূনতম আট থেকে ১০ হাজার পুলিশ সদস্য প্রয়োজন। বেশ কয়েক বছর ধরে নতুন করে চার হাজার পুলিশ সদস্য নিয়োগের আবেদন করে আসছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সর্বশেষ এক হাজার ৪৫০ জনকে নিয়োগ দেয়ার কথা থাকলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। জনবল ও আধুনিক সরঞ্জামের অভাব, ট্রেনে তল্লাশি না হওয়াসহ স্টেশনগুলো প্রায় উন্মুক্ত থাকায় চোরাকারবারিরা রেলপথকে নিরাপদ মনে করছে।

ঢাকা রেলওয়ে থানার ওসি ইয়াছিন ফারুকী জানান, রেলওয়ে পুলিশ ইয়াবাসহ মাদক প্রতিরোধ ও অপরাধীদের গ্রেফতারে তৎপর রয়েছে। কিন্তু, বিশেষ করে কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন হয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী চলাচল করে। যাত্রীবেশেই অপরাধীরা মাদক পাচার করে আসছে। গোপন সংবাদ ছাড়া তেমন কাউকে তল্লাশি কিংবা শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, প্রতি মাসেই পাঁচ-ছয় হাজার ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক বহনকারীকে আটক করা হচ্ছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, যাত্রীবেশী চোরাকারবারিরা পায়ু, যৌনাঙ্গ, পেটের ভেতর করে ইয়াবা পাচার করছে।

চট্টগ্রাম রেলওয়ে জেলার পুলিশ সুপার নওরোজ হাসান তালুকদার জানান, ট্রেনে যাত্রীবেশে চোরাকারবারিদের আটক করতে রেলওয়ে পুলিশও বিভিন্ন কৌশল নিচ্ছেন। কিন্তু লোকবলের অভাব থাকায় তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। নারী চোরাকারবারিরাও রেলপথ ব্যবহার করছে। তার আওতায় মাত্র ছয়জন নারী পুলিশ রয়েছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, যৌনাঙ্গ কিংবা পায়ুপথে ইয়াবা পাচারকারীদের প্রায় গ্রেফতার করা হচ্ছে।

শুধু চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে প্রতি মাসে গড়ে পাঁচ হাজার ইয়াবা জব্দসহ আসামিদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। এ স্টেশনটির চতুর দিক দিয়ে সাধারণ মানুষ তথা যাত্রীসাধারণ প্রবেশ এবং বের হচ্ছে, এতে করে কে যাত্রী, কে চোরাকারবারি তা চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। স্টেশনে কোনো যাত্রী স্ক্যানিং মেশিন কিংবা লাগেজ স্ক্যানার নেই। এ দুটি মেশিন এ স্টেশনে নিশ্চিত করার জন্য বহুবার বলা হলেও কার্যকর হচ্ছে না।

এ বিষয়ে রেলওয়ে পুলিশের এডিশনাল ডিআইজি মোহাম্মদ মোর্শেদ আলম জানান, হাজার হাজার ট্রেনযাত্রীর মধ্যে মিশে থাকে চোরাকারবারিরা। পুলিশ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে চোরাচালান রোধে ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করছে। পর্যাপ্ত লোকবল ও সরঞ্জামের অভাব থাকায় এ পথে মাদক চালান পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, চোরাচালান রোধে সাধারণ যাত্রীদেরও বিশেষ ভূমিকা থাকা দরকার। সন্দেহজনক যাত্রী কিংবা চোরাকারবারিদের ধরিয়ে দিতে, তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান তিনি।
সূত্র: যুগান্তর


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply