শরবত শ্রেণি ও সোশ্যাল হায়ারার্কি

|

আমিন বাবু

সমাজে বাস করা একজন ব্যক্তি যতভাবে শ্রেণিবিভেদ সৃষ্টি করতে পারে তার একটি কথা বা বক্তব্যের মাধ্যমে। শ্রেণি সমাজ বা ক্লাস মানুষকে (আমরা যাকে ‘গণ’ বলি) কী দৃষ্টিতে দেখে তা আরেকবার জানা গেল জল ঘোলা হওয়ায়। মিজানুর বনাম তাকসিমের বদৌলতে ওয়াসার সে পানি অনেকদূর গড়িয়েছে।

নোংরা পানি সরবরাহ করায় একজন শরবত খাওয়াতে চাইলেন অন্যজন বললেন ‌’পাগল’। একদিকে সমাজের বঞ্চিত, ক্ষুব্ধ শ্রেণি অন্যদিকে সমাজের সুবিধাভোগী। মতভেদ আছে অনেক। এ অবস্থায় মন্ত্রীরা যখন বলেন, ‘লাখ লাখ মানুষ এ পানি খেয়ে বেঁচে আছে’, কিংবা ওয়াসার এমডি যখন শতভাগ সুপেয়র পক্ষে যুক্তি দেন তখন তা ব্যক্তির প্রতি ব্যক্তির নিরীহ মন্তব্য থাকে না; সমাজের একটি শ্রেণির প্রতি আরেকটি শ্রেণির অবজ্ঞা প্রকাশ পায়। মিজানুরের শরবতের প্রয়াস এই তাচ্ছিল্যের সব উত্তর দেয় না, দিতে পারে না। সামাজিক প্রতিবাদের এই ভাষার পেছনে অব্যক্ত অনেক কথা রয়ে যায়। রয়ে যায় তাকসিম খানদের সোশ্যাল হায়ারার্কির গল্প।

তাকসিম খান, সচিব বা মন্ত্রীদের একাংশের বিদ্বেষী কটাক্ষ নতুন কিছু নয়। স্মৃতি হাতড়ে গত দুই দশকে এমন অজস্র মন্তব্য স্মরণে ধরা দেয়। কেন তারা এমন কথা বলেন, যখন তা সমাজের বড় অংশের স্বার্থবিরোধী এবং আত্মঘাতী। এই ব্যাপারটা বুঝতে তাদের মানসিক নকশার দিকে নজর দিতে হবে।

সমাজের উচ্চ শ্রেণিতে বসবাসরত তাকসিম খান জানেন কাউকে পাগল বলা বর্ণবাদের শামিল। তা জেনেও বলছেন কারণ তিনি অ্যান্টিপ্যাথিস্টদের প্রতিনিধি। তার কাছে ঘৃণা দিয়েই সবকিছুর শুরু এবং এই ঘৃণাই সেলফ হেল্প বা মোটিভেশনের অংশ। নেগেটিভ মোটিভেশন বা সেলফ হেল্প আমাদের শেখায় ইন্ডিভিজ্যুয়ালিস্ট হতে। বলে, আপনার সমাজ দেখার দরকার নাই, আপনি নিজেরটা বুঝতে শিখুন। এই ন্যারো মোটিভেশনের আন্ডারলাইন ম্যাসেজ হলো- শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবো। নিজের সাকসেস আর প্রগ্রেসই শেষ কথা। যেহেতু তাকসিম খান পদসোপান বা হায়ারার্কির মাধ্যমে সামাজিক অবস্থান নিশ্চিত করেছেন তাই তার সেলফ হেল্পও ধীরে ধীরে উচ্চকিত হয়। তার মোটিভেশন লেভেলের সাথে শৈশবের স্কুল শিক্ষক বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরের পার্থক্য বাড়তে থাকে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় অবচেতন এই ধারা সম্পর্কে মানুষ কখনই ওয়াকিবহাল নয়। যেহেতু তাকসিম খান ইন্ডিভিজ্যুয়ালিস্ট হয়ে উঠছেন তাই তিনিও তার নৈতিক বাধাগুলোকে অস্বীকার করতে থাকেন। ক্রমেই ইন্ডিভিজ্যুয়ালিটি তার কনজ্যুমার কালচারে অংশ হয়ে যায়। ইগো তাকে সোশ্যাল প্রবলেম না দেখে চলতে বলে। একইসাথে সমাজ চালনার যে পাওয়ার সিস্টেম আছে শুধু তার পারপাস সার্ভ করতে শেখায়।

মানসিকতা গড়ে ওঠার বিষয় বুঝতে সরকারি চাকরির প্রধান বাছাইয়ের দিকে নজর ফেরাতে হবে। সেটা সিভিল সার্ভিসের দিকে। যেহেতু বিসিএস’ই তাকসিমদের আঁতুরঘর সেহেতু গোড়ার দিকেই দৃষ্টিপাত হোক। ধরা যাক, একজন বিসিএস ক্যাডার। তিনি সরকারি চাকরি পেয়ে গেলেন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলো মেধাবীরাই জায়গা পেয়েছে। এখন দেখা যাক আসল ব্যাপারটা কী।

আমরা জানি মেরিটোক্রেসি বা মেধার ব্যাখ্যা এখানে ছেলে ভোলানো। মেধা নির্ভর করে সোশিও ইকোনমি ক্লাস, অ্যাডভান্টেজ, অন্যের সহযোগিতা আর জিনগত কিছু বিষয়ের উপর। এগুলো পেয়ে আমরা একটা জায়গায় যাই। সুতরাং নির্ধারিত কিছু প্রশ্নে মেধার যাচাইটা ভুল। আসল ব্যাপার হচ্ছে, কর্মসংস্থানের তুলনায় আবেদনকারীর সংখ্যা বেশি। এই সত্য ঢাকতে মেধার মিথে আশ্রয় নেয়া লাগে।

এবার আসার যাক, যে ক্যাডারে সুযোগ পেল তার কাছে। যেহেতু রাষ্ট্র ও সমাজ তাকে শিখিয়েছে ‘তুমি মেধাবী’ সুতরাং সে ভাবতে থাকে সে সবকিছু তার মেধার জোরেই পাচ্ছে। এটাই তার যোগ্যতা। এটা সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যা। তাকসিম খানদের মত ‘মেধাবীরা’ মেধার যুক্তিতে সোসাইটির অবদান অস্বীকার করেন। নিজেকে সুপিরিয়র আর অন্যদের ইনফেরিওর হিসেবে গণ্য করতে থাকেন। চারপাশকে অস্বীকার করে ইন্ডিভিজ্যুয়ালকে গড়ে তোলেন। অর্থাৎ নিজেকে। তিনি যতটুকু পছন্দ করেন ততটুকুই তার সমাজ, দুনিয়া। ক্যারিয়ারের গোড়ায় আত্তি করা মেরিটোক্রেসি একসময় ব্যক্তির আচরণে প্রকাশ পায়। তিনি বিশ্বাস করেন, তার আজকের অবস্থানের জন্য একজন রিকশাওয়ালা বা সবজি বিক্রেতার কোন ভূমিকা নেই; স্কুলের দপ্তরি বা রাস্তার ঝাড়ুদার অস্পৃশ্য। ব্যক্তি ভাবতে থাকে, সে এ জায়গায় আছে তারমানে ইচ্ছেমত তার পজিশন এক্সপ্লোয়েড করতে পারে। তাই এথিকসের ধার ধারে না। তার লাইফ সোসাইটির অংশ বলে স্বীকার করে না। ব্যক্তি বোঝাতে চায় মানুষের তাকে দরকার, তার মানুষকে নয়। দায় পালনে অরুচি অথচ দায়িত্ব থেকে সরতে আপত্তি। এভাবে ভোগ জারি রাখা হয়। এমন মানুষ আলাদা শ্রেণি তৈরিতে সচেতন থাকে। সাকসেসের ডেফিনেশন নিজের মত তৈরি ও ব্যাখা করেন। সেখানে মানুষ বা গণ’কে অস্বীকার করা হয়। ধীরে ধীরে খারিজ করতে থাকেন সোশ্যাল সিস্টেমকে।

অথচ অ্যান্টিপ্যাথিস্টরা যদি চিন্তা করতো কী কী সুবিধা চারপাশের মানুষের কাছ থেকে পেয়েছে। সে যদি ভাবতো সবার সাহায্যেই একজন মানুষ সমাজে বেঁচে থাকে এবং আমরা পরস্পর কানেক্টেড; তাহলে তার বেটারমেন্টের যাত্রাটা নিশ্চয়ই ভিন্ন হতো।

একটা অংশ আছে তাকসিমের বিপরীত। তারা শরবর শ্রেণি। মিজানুর এই শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী। মিজানুর জানেন সমাজের প্রতি দায় আছে। কোন অন্যায় হলে তার প্রতিবাদ করতে হবে। যদি না করেন তাহলে তিনি নিজেও ওই নিষ্ঠুরতার অংশ। এগুলো অস্বীকার করার বিষয় না। দেখা যায়, সমাজের একটা অংশ যখন সমস্যা পাশ কাটিয়ে যায় তখন মিজানুর তা ডিনাই করতে পারেন না। মানুষ চিরকাল এসকেপিস্ট ঠিকই কিন্তু মিজানুররা এখনো লুপ্ত নয়।

তাকসিম খানদের মত একাংশ সামাজিক বিশুদ্ধতার নামে প্রচীন ঘৃণা বয়ে বেড়াচ্ছেন। তাদের অবস্থান ও দায়িত্বকে তারা ব্যবহার করেন নিজের উপযোগীতার জন্য, সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে নয়। তাই সমাজের বড় অংশের প্রতি তাদের অবজ্ঞা ও ঘৃণা চিরকাল। এই আদি ঘৃণা বা ‘অ্যান্টিপ্যাথি’ মানব জাতির মজ্জাগত। হিটলারও এই ঘৃণার বাহক ছিলেন। হিটলার বিশ্বাস করতেন জার্মান জাতির পূর্বপুরুষ আরিয়ানরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি ছিল কিন্তু জেনেটিক ত্রুটি সম্পন্ন নিচু জাতের মানুষের সঙ্গমে ধীরে ধীরে জাতিগত নিচুতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে। তাই সে উদ্যোগ নেয় শ্রেষ্ঠত্ব ফেরানোর। হলোকাস্ট তারই ফল। হিটলার মনেপ্রাণে ঘৃণা করতেন নিচু জাত আর প্রতিবন্ধীদের। তার মতে, এঁরা জিনগত ত্রুটি নিয়ে জন্মানো। এদের মাধ্যমে ক্রসবিডে একটি দুর্বল জাতি গড়ে ওঠে।

হিটলার, তাকসিম, আমলা বা জনপ্রতিনিধিদের একাংশ একটা পর্যায়ে অ্যান্টিপ্যাথিস্ট। তারা ক্ষমতা আর ঘৃণার মিথস্ক্রিয়ায় ভাবেন, কথা বলেন। কেননা তাদের এভাবে ভাবতে শেখানো হয়, বলতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। সমাজের অবদান অস্বীকার করতে জানলেই কেবল এ বিদ্যা অর্জন করা সম্ভব।


লেখক: সাংবাদিক


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply