‘গোপন দরপত্রে’ ১১০টি খাস পুকুর লিজ, প্রশাসনের বিরুদ্ধে কমিশন বানিজ্যের অভিযোগ

|

জিল্লুর রহমান পলাশ, গাইবান্ধা:

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে গোপনে দরপত্র আহবান করে ১২১টি সরকারি খাস পুকুরের মধ্যে ১১০টি লিজ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। এসব পুকুর লিজে সরকারি নীতিমালর তোয়াক্কা করা হয়নি। কমিশনের মাধ্যমে উপজেলা প্রশাসন পুকুরগুলো বরাদ্দ দিয়েছে বলে অভিযোগ মৎসজীবিদের। গোপনে এসব পুকুর লিজের কারণে একদিকে ক্ষতির মুখে পড়েছেন মৎসচাষিরা। অন্যদিকে মোটা অংকের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে সরকার।

এদিকে, অনিয়মের মাধ্যমে পুকুরগুলো লিজের ঘটনায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে এলাকার প্রকৃত মৎসজীবিদের মধ্যে। লিজ প্রদানের প্রতিবাদে এবং তা বাতিল করে পুণ: দরপত্রের দাবিতে মানববন্ধনসহ জেলা প্রশাসক বরাবরে লিখিত অভিযোগ করেছেন মৎসচাষিরা।

জানা গেছে, গোবিন্দগঞ্জে ছোট-বড় মিলে প্রায় চার শতাধিক সরকারী খাস পুকুর রয়েছে। তিন বছর মেয়াদী এসব পুকুর মৎসজীবিদের নিয়ে গঠিত সমিতিকে লিজ দেয় উপজেলা প্রশাসন। এলাকার মৎসজীবিরা এসব পুকুরে মাছ চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। মেয়াদ শেষ হওয়ায় প্রথম পর্যায়ে ১২১টি (২০ কুড়ি একর) পুকুর ইজারা দিতে দরপত্র আহবান করে ২৪ ফেব্রুয়ারী বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে উপজেলা প্রশাসন। গত ৬ মার্চ দরপত্র দাখিলের শেষ দিন ছিল। নির্ধারিত দিনে দরপত্র দাখিলকে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীন দলেরমমধ্যে গ্রুপিং দেখা দেয়। এতে দরপত্র জমা দিতে এক গ্রুপ অন্য গ্রুপকে বাঁধা দেয়। এক পর্যায়ে নেতাকর্মীদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসময় ভাঙচুর করা হয় উপজেলা পরিষদ চত্তরের বেশ কিছু দোকানপাট। সংঘর্ষে সাংবাদিকসহ উভয়পক্ষের অন্তত ১৪ জন আহত হন। পরে শর্টগানের গুলি ও লাঠিপেটা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনে পুলিশ। এ পরিস্থিতিতে দরপত্র দাখিল স্থগিত করে পরবর্তীতে পুনঃদরপত্র আহবানের ঘোষণা দেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার রাম কৃষ্ণ বর্মণ।

এরেই মধ্যে উপজেলা প্রশাসন গোপনে দরপত্র আহবান করে ১২১টি পুকুরের মধ্যে ১১০টি পুকুর লিজ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে বলে জানতে পারেন এলাকার মৎসজীবিরা।

মৎসজীবিদের অভিযোগ, প্রভাবশালী মহলের যোগসাজসে ২৪ মার্চ গোপনে স্থানীয় একটি পত্রিকায় দরপত্র আহবান করে উপজেলা প্রশাসন। ২৪ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত পুনঃদরপত্র বিক্রি ও দাখিলের শেষদিন দেখানো হয় ৩ এপ্রিল। অথচ পুনঃদরপত্র আহবানের বিষয় জানেন না প্রকৃত মৎসজীবিদের কেউ। এমনকি উপজেলা পরিষদ ও ভুমি অফিসেও দরপত্র বিজ্ঞপ্তির কোন নোটিশ টাঙানো হয়নি। তাছাড়া দরপত্র আহবানের নোটিশ সংশ্লিষ্ট ইউপি চেয়ারম্যান ও তহসিলদারকে দেয়ার কথা থাকলেও কেউ নোটিশ পায়নি।

মৎসজীবিদের অভিযোগ, লাখ লাখ টাকা কমিশন আদায় করে নামমাত্র অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দিয়ে পুকুরগুলো লিজ দেয়া হয়েছে। ইউএনও’র যোগসাজসে ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও প্রভাবশালীরা এসব পুকুর সমিতির নামে লিজ নিয়েছে। লিজ দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারী নীতিমালা মানা হয়নি। একটি সমিতির নামে দুটি পুকুর লিজের কথা থাকলেও ১১০টি পুকুর লিজ হয় ১২ থেকে ১৪টি সমিতির নামে।

গুমানীগঞ্জ মৎসজীবি সমিতির সভাপতি ধলু মিয়া বলেন, অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে এসব পুকুর লিজের কারণে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে। উন্মুক্ত দরপত্র আহবান করা হলে সরকারের রাজস্ব আয় হতো। কিন্তু তা না করায় পকেট ভারী হয়েছে প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের। সুষ্ঠ তদন্ত করলে অনিয়মের বিষয়টির প্রমাণ মিলবে বলেও দাবি করেন তিনি।

রাজাহার ইউনিয়ন মৎসজীবি সমিতির সভাপতি আবদুস ছাত্তার মিয়া বলেন, এরআগে পুকুর লিজ নিয়ে মাছ চাষ করছেন। পুকুরে এখন ছোট বড় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ আছে। প্রথম পর্যায়ে দরপত্র আহবানের শেষদিনে আবেদন করতে গিয়ে আবেদন করতে পারেননি। কিন্তু পুণ:দরপত্র আহবানের বিষয়টি জানেন না তিনি। কোন নোটিশ বা মাধ্যমে জানতে পারেননি। এখন শুনছি পুকুর লিজ হয়েছে। পুকুর লিজ পাওয়া লোকজন পুকুর দখলে নিতে চাচ্ছেন। এমন অবস্থায় পুকুরের মাছ নিয়ে কি করবেন বুঝতে পারছেনা।

শুধু সাত্তার মিয়া নয়, তার মতো অনেকেই পুকুর লিজ না পওয়ায় ক্ষতির মুখে পড়ছেন। পুকুর লিজ না পাওয়ায় সংসার চালাবেন কি করে সে চিন্তায় এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন এলাকার মৎসচাষিরা।

এদিকে, গোপনে পুকুর লিজের প্রতিবাদে ক্ষোভ ও উত্তেজনা বিরাজ করছে মৎসজীবিদের মধ্যে। পুকুর লিজ বাতিল ও পুণঃ দরপত্রের দাবিতে উপজেলার ১৬টি মৎসজীবি সমিতির পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসক বরাবরে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। সম্প্রতি গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চত্তরে পুকুরগুলোর লিজ বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন মৎসজীবিরা। লিজ বাতিল না হলে উচ্চ আদালতের স্মরণাপন্ন এবং কঠোর অন্দোলনে নামার ঘোষণা দেয় মৎসজীবিরা।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করছেন গোবিন্দগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাম কৃষ্ণ বর্মণ। তিনি বলেন, পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে দরপত্র আহবান করা হয়েছে। পুকুর লিজ নিয়ে কোনো অনিয়ম হয়নি। তবে একটি সমিতি একাধিক পুকুর লিজ পাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে উপজেলা জলাশয় বন্দোবস্ত কমিটি।

তবে পুকুর লিজ নিয়ে মৎসজীবিদের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন জেলা প্রশাসক আবদুল মতিন।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply