চা বিক্রেতা এবং আইসক্রিমওয়ালার ২ ছেলেকে বেছে নিয়েছেন আকাশ

|

ফেসবুকের নিউজ ফীডে ক্রল করতে গিয়ে পোস্টারটা চোখে পড়লো। মনে হলো বিজ্ঞপনদাতাকে একটা কল করা যাক। তিনি কি তার কাঙ্খিত দুইজন ছাত্র-ছাত্রী পেয়েছেন কিনা?

কল রিসিভ করলেন আকাশ। পরিচয় দিয়ে জানতে চাইলাম, ;কেমন আছেন? আপনার কাঙ্খিত ছাত্র-ছাত্রীদের পেয়েছেন কি?’ ‘জ্বি ভাই, পেয়েছি’ বলে জানালেন তিনি। এরপর কথা হলো বেশ কিছুক্ষণ। জানালেন তার এই উদ্যোগের বিষয়ে।

আবীর হাসান আকাশ ঢাকা কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। সদ্য ২য় বর্ষ থেকে ৩য় বর্ষে উন্নীত হয়েছেন। এখনও ক্লাস শুরু হয়নি। ক্লাস যখন থাকে, তখনও দুপুরের পরে অবসর থাকেন। ব্যবসায়ী বাবার ছেলে আকাশের পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতাও আছে। ফলে অন্য আরও অনেক শিক্ষার্থীর মতো তাকে নিজের চলার খরচ জোগানোর জন্য টিউশনি করতে হয় না। দুপুর থেকে বিকালের সময়টাকে ফলপ্রসূভাবে কাটানোর চিন্তা থেকেই তার মাথায় এলো টিউশনি করানো যায়।

যে ভাবনা সেই সিদ্ধান্ত। তবে ব্যতিক্রম হলো, টিউশনি পড়ানারো বিনিময়ে তিনি কোনো পারিশ্রমিক নেবেন না। আর যেহেতু পারিশ্রমিক নেবেন না, তাহলে যাদেরকে পড়াবেন তারা যদি গরীব ঘরের সন্তান হন তাহলে সবচেয়ে ভালো।

ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে দেয়ালে ঝুলতে দেখা যায়, শত শত পোস্টার। ‘পড়াতে চাই’, ‘ছাত্রছাত্রী চাই’ ইত্যাদি। আকাশও চিন্তা করলেন কয়েকটা পোস্টার লাগাবেন। ঢাকা কলেজের আশপাশের এলাকায় কয়েকটি স্থানে লাগালেন এই পোস্টার। “দরিদ্র ও মেধাবী দুই জন ছাত্র/ছাত্রীকে পড়াতে চাই”। সাথে বক্সে বড় করে লিখে দিলেন “বিনা পারিশ্রমিকে”।

এই শব্দ দুটিই আকাশের পোস্টারকে অন্যসব পোস্টার থেকে আলাদা করে দিলো। শিক্ষক খুঁজতে থাকা মানুষদের আগ্রহ হলো এই হবু শিক্ষককে নিয়ে। যারা শিক্ষক খুঁজছেন না, তারও দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো এতে।

আকাশ জানালেন, দুই সপ্তাহ আগে লাগিয়েছিলেন পোস্টার। এরপর থেকে ফোন কলে অতিষ্ঠ হওয়ার উপক্রম তার! ঢাকার নানা প্রান্ত থেকে কল এসেছে। তাদের সন্তানকে যদি পড়াতেন তিনি। ঢাকা কলেজের দক্ষিণ হোস্টেলে থাকা এই ছাত্র জানালেন, উত্তরা, মিরপুর মোহাম্মদপুর এসব দূরের এলাকা থেকেও কল পেয়েছেন।

কিন্তু হোস্টেল থেকে বেশি দূরে কোথাও ক্লাস নিতে গেলে ঢাকার জ্যামে তার দিন চলে যাবে। এ কারণে ধানমণ্ডি, নিউ মার্কেট আর আজিমপুর থেকে পাওয়া কয়েকটি ফোন কলকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এরপর এক সপ্তাহে ১১/১২টি বাসায় গিয়েছেন। তার মূল লক্ষ্য ছিল অপেক্ষাকৃত বেশি দরিদ্র এবং মেধাবী দুইজন শিক্ষার্থীকে বেছে নেয়া; যাতে তার পরিশ্রমটি সফল হয়।

অবশ্য ‘মেধাবী’ খুঁজতে গিয়ে অনেকের প্রশ্নের মুখে পড়েছেন- ‘কম মেধাবীরা কি পড়াশোনা করবেন না? তাদেরকে উপেক্ষা করছেন কেন?’ আকাশ এর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তার মতে, ‘মেধাবী’ বলতে তিনি মনোযোগী শিক্ষার্থীদের বুঝিয়েছেন।

‘বছর শেষে যদি দেখা যায় যে, মনোযোগী না হওয়ার কারণে ছেলে বা মেয়েটির পেছনে আমার চেষ্টা বিফল হয়েছে তাহলে খারাপ লাগবে’, বললেন তিনি।

যাচাইবাছাই শেষে আজিমপুরের এক আইসক্রিম বিক্রেতার ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া ছেলেকে এবং নিউ মার্কেটের পেছনের আইয়ুব আলী কলোনিতে থাকা এক চা বিক্রেতার তৃতীয় শ্রেণিতে পড়া ছেলেকে নিজের হবু ছাত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন আকাশ। তার কাছে মনে হয়েছে এই দুই বাবারই তাদের ছেলের চাহিদা অনুযায়ী পড়াশোনা করানোর সামর্থ্য নেই। তাই এদেরকে বেছে নেয়া।

ইতোমধ্যে বাসায় গিয়ে ছাত্রদের সাথে পরিচিত হয়ে এসেছেন। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে সপ্তাহে ৩/৪ দিন করে একেকজনকে দুপুরের পরে সময় দেবেন বলে ঠিক করেছেন।

২০১৬-১৭ সেশনে ঢাকা কলেজে ভর্তি হওয়া আকাশের গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ সদরে। বাবা-মায়ের পরিচয় প্রকাশে আগ্রহী নন তিনি। জানালেন, শুধু শিক্ষার্থী পড়ানোর উদ্যোগই নয়, তিনি নিয়মিত চেষ্টা করেন দরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের নিজে থেকে সহায়তা করতে। এতিমদের জন্য কিছু করতে চান। কয়েকদিন আগে মাদ্রাসার এক এতিম ছাত্রকে একটা পাঞ্জাবি বানিয়ে দিয়েছেন।

আকাশের মা তাকে এমন কাজে উৎসাহ দেন। এবার শীত শুরু হওয়ার পর মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কলেজের পাশে ১০ জনকে শীতের কাপড় কিনে দিয়েছিলেন বলেও জানান। “আমার বন্ধুরা আমার এসব কাজের বিষয়ে জানে। তাই তারা কোথাও কোনো ছাত্রছাত্রী পেলে অনেক সময় আমার কাছে নিয়ে আসে। আমি সাধ্যমতো চেষ্টা করি ওদেরকে কিছু দিতে। বই-গাইড এগুলো কিনে দেই”, বললেন তিনি।

কলেজেরর হলে নিজের রুমে তারা ছয়জন থাকেন। আকাশে ভাষ্য, “বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষার্থী পড়ানোর উদ্যোগটা নেয়ার পর তাদের কেউ কেউও এই চিন্তা করতেছে আমার মতো এভাবে পড়াবে।”


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply