সৌদি-ইরাক সম্পর্কে হঠাৎ এত উষ্ণতার রহস্য কী?

|

সীমান্তবর্তী দুই দেশ, অথচ একটিতে অন্যটির দূতাবাস নেই- এমন দৃষ্টান্ত বেশি নেই বিশ্বে। সৌদি আরব ও ইরাকের মধ্যে সম্পর্কের ইতিহাস এতটাই খারাপ যে, একটানা ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে দু’দেশেই পরস্পরের দূতাবাস ছিল না। আশির দশকের শেষের দিকে সাদ্দাম হোসেনের অতিউৎসাহে শুরু হওয়া উপসাগরীয় যুদ্ধের পর থেকেই দেশ দুটির সম্পর্কের এত অবনতি ঘটে। সৌদি তার সীমান্তের ইরাক অংশটুকু বন্ধ করে দেয়। শুধু ইরাকি হজযাত্রীরা ঢুকতে পারতেন সৌদিতে।

২০১৪ সালে আইএসের উত্থানের পর বাগদাদের সাথে শীতলতা কমিয়ে আনতে চেয়েছিলেন তৎকালীন বাদশাহ আব্দুল্লাহ। সেই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ইরাকে দূতাবাস খোলা হয় ২০১৫ সালে। উদ্দেশ্য ইরাক সরকারের সাথে মিলে উগ্রপন্থা দমনে কাজ করা। অন্যথায় শঙ্কা ছিল, সীমান্তবর্তী সৌদিও আক্রান্ত হতে পারে জঙ্গিদের দ্বারা।

কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে সৌদির চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ইরানও বসে ছিলনা। ইরাকের জনগোষ্ঠি ও সরকারের মধ্যকার ধর্মীয় বিভাজনকে বেছে নেয় নিজেদের স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে। শিয়া প্রভাবিত সরকারকে সুন্নী আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামরিক, আর্থিক সুবিধা দিয়ে নিজেদের প্রভাব বাড়িয়েছে তেহরান। ইরানিরা মধ্যপ্রাচ্যের যে চারটি রাজধানীকে নিয়ন্ত্রণ করে বলে গর্ববোধ করে থাকে, তার মধ্যে বাগদাদ অন্যতম (বাকিগুলো হল দামেস্ক, বৈরুত ও সানা’)। তাই সৌদির পক্ষ থেকে সম্পর্কন্নোয়ন করার চেষ্টা সফল হয়নি; উল্টো আরও অবনতি ঘটে। গত বছরও সৌদি আরবের বিরুদ্ধে কড়া মন্তব্য করেছিলেন ইরাকি নেতারা।

কিন্তু গত এক বছর ধরে বাগদাদের সাথে মিলমিশ করে নিতে নতুনভাবে উদ্যোগ নিয়েছে রিয়াদ। দুই দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা সফর বিনিময় করছেন গত কয়েক মাস ধরে। এর মধ্যে রয়েছে সৌদি রাজপ্রাসাদে ইরাকী শিয়া নেতা মুকতাদা আল সদর, বাগদাদে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আল জুবেরি ও তেল বিষয়কমন্ত্রী খালিদ আল ফালিহের সফর, এবং সর্বশেষ ইরাকি প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল আবাদীর চলমান রিয়াদ সফর। মধ্যখানে আরও বেশ কিছু রাষ্ট্রীয় সফর আদান-প্রদান হয়েছে। হায়দার আল আবাদী সফরকে মনে করা হচ্ছে দুই দেশের সম্পর্কে নতুন অধ্যায়ের সূচনা।

প্রশ্ন হচ্ছে, এত তিক্ত ইতিহাসকে ভুলে ইরাকের সাথে নতুনভাবে সম্পর্ক শুরু করতে এত মরিয়া কেন সৌদি আরব? আর হুট করেই এক দেশের সরকারপ্রধান আরেক দেশ সফরে যাওয়ার মতো ‘উষ্ণ’ সম্পর্ক হয়ে ওঠার পেছনের রহস্য কী?

এ বিষয়ে একটি বিশ্লেষণী নিবন্ধ প্রকাশ করেছে বার্তা সংস্থা এপি। ‘Tillerson aims for Saudi-Iraq axis against Iran’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশ দুটির মধ্যকার সম্পর্কন্নোয়নে মূলত যুক্তরাষ্ট্র জোরালো ভূমিকা রাখছে। ওবামা প্রশাসন ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তি করে যাওয়ার ফলে মার্কিন মিত্র সৌদি ও ইসরায়েল ক্ষুব্ধ। এই চুক্তির ফলে তেহরানের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় ইরান অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে আরও সক্ষম হয়ে উঠছে বলে মনে করে রিয়াদ ও তেলাবিব। এবং সেই সক্ষমতা ব্যয় করছে সিরিয়া, ইরাক, লেবানন ও ইয়েমেন তার প্রভাব বিস্তারের কাজে।

ট্রাম্প প্রশাসনও রিয়াদ ও তেলাবিবের উদ্বেগ আমলে নিয়েছে। তাই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রায়ই পরমাণু চুক্তির বিপক্ষে বলে থাকেন। কিন্তু চুক্তিটির সাথে বিশ্বের অন্যান্য শক্তিগুলো জড়িত থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে একপক্ষীয়ভাবে সেটি বাতিল করা সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় ইরানের কবল থেকে তার মিত্রদেরকে বের করে নিয়ে সৌদির প্রতি ঝুঁকানোর চেষ্টাই করছে ওয়াশিংটন।

আইএসের দ্বারা এবং এই জঙ্গি সংগঠনটির সাথে যুদ্ধ করতে গিয়ে ইরাকের অবকাঠামোগত যে বিরাট ক্ষতি হয়েছে তা পূণর্গঠনে সহায়তা করতে চায় সৌদি আরব। এর মাধ্যমে বাগদাদে নিজেদের উপস্থিতি জোরালো করে তেহরানের প্রভাব কমাতে চায় রিয়াদ। এই মুহুর্তে রিয়াদ সফর করছে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন। হায়দার আল আবাদীও সেখানে আছেন। আজ রোববার নবগঠিত সৌদি-ইরাক কোঅর্ডিনেশন কমিটির বৈঠক হবে। তাতে বাদশাহ সালমান ও আবাদীর সাথে টিলারসনও অংশ নেবেন। ইরাকের পূণর্গঠন প্রস্তাবে সম্মত হতে দেশ দুটিকে প্রভাবিত করবেন তিনি।

ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ম্যাকমাস্টার গত সপ্তাহে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র স্থিতিশীল ইরাক দেখতে চায়, তবে সেই স্থিতিশীল ইরাক নয় যেটি ইরানের বগলদাবা হয়ে থাকবে। তিনি এই ইঙ্গিতও দিয়েছেন যে, সৌদি আরব এ ক্ষেত্রে ভূমিকা নিতে পারে।

এ থেকে স্পষ্ট, সৌদি-ইরাক সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পেছনে মূল ভূমিকা পালন করছে যুক্তরাষ্ট্র।

/কিউএস


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply