অজ্ঞাত ছেলেটিকে হাসপাতালে মাতৃস্নেহ দিচ্ছেন লাকি আলম

|

বি.এম খোরশেদ,মানিকগঞ্জঃ

বয়স আনুমানিক ১২/১৩। গায়ের রং ফর্সা। মায়াবী চেহারা। দেখে যে কারো মায়া লাগারই কথা। কিন্তু সোজা হয়ে বসতে না পারায় ছেলেটি পায়খানা-প্রসাব করে বিছানাতেই। তাই তার কাছে কেউ চাপতে চায় না। মাথাসহ শরীরের বিভিন্নস্থানে আঘাতের ক্ষত রয়েছে। অজ্ঞাত পরিচয়ের এই ছেলেটি ২১ দিন ধরে মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। কে বা কারা তাকে ভর্তি করেছেন তার কোন তথ্য নেই হাসপাতালে।

শুরুতে দায়সারাভাবেই চলছিলো তার চিকিৎসা। হাসপাতালের বাড়ান্দায় পড়েছিলো কয়েকদিন। ১০ দিন ধরে অজ্ঞাত ছেলেটির চিকিৎসায় পাশে দাঁড়িয়েছেন লাকি আলম নামে এক নারী।

সার্বক্ষনিক সেবা শুশ্রুষার জন্য তিনি নিয়োগ দিয়েছেন অপর এক নারীকে। প্রয়োজনীয় ওষুধ ও খাবার কিনে দিচ্ছেন লাকি।

শুক্রবার হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, ৬ তলায় পুরুষ ওয়ার্ডের একটি রুমের(৩১-৩৬)ফ্লোরে আছে ছেলেটি। মুখে ভাত তুলে খাওয়াচ্ছেন লাকি আলম। এরপর মাথায় তেল দিয়ে দেন। ছেলেটির সাথে কথা বলার চেষ্টা করলে সে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।

মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার আরিচা ঘাটে নিজের নামে একটি পার্লার ব্যবসা পরিচালনা করেন লাকি আলম। এক ছেলে ও এক মেয়ের মা তিনি।

লাকি আলম জানান,১০ দিন আগে মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যা হাসপাতালে এক স্বজনকে দেখতে এসেছিলেন তিনি। এসময় বারান্দায় ছেলেটিকে পড়ে থাকতে দেখেন। আশে পাশের রোগী ও স্বজনদের কাছে জানতে পারেন ছেলেটির কেউ নেই।তার কোন পরিচয়ও জানেন না কেও। তাই তার পরিচর্যা হচ্ছে না। মাথায় ও হাতে গুরুতর জখমের চিহ্ন ছিলো তখন।কোমড়সহ সারা শরীরেই আঘাতের চিহ্ন। বিছানা রক্তে ভিজে যাচ্ছিল। শিশু ছেলেটির কাছে যেতেই মায়াবি দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। এসময় খুবই মায়া হয় ছেলেটিকে দেখে। তখনই ডাক্তার ও নার্সদের কাছে খোঁজ খবর নেন ছেলেটির অবস্থা সম্পর্কে।

এরপর অসহায় এই শিশুটির সাহায্যে এগিয়ে আসেন তিনি। ডাক্তার ও নার্সদের সাথে কথা বলে তার জন্য ওষুধ ও খাবার কিনে আনেন। সেই থেকে প্রতিদিন তার দেখাশুনা করছেন তিনি।

ৱছেলেটির সেবা শুশ্রুষার জন্য প্রতিদিন ৩০০ টাকা মজুরিতে এক নারীকেও নিয়োগ দিয়েছেন লাকি। নিজেও প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পযন্ত ছেলেটির পাশে থাকছেন। মায়ের স্নেহ আর ভালবাসা দিচ্ছেন। শুধু তাই নয় ছেলেটির পরিচয় খোঁজার জন্য তিনি জেলা প্রশাসন,থানা পুলিশ,সংবাদকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্ত হচ্ছেন।

লাকি আলমের এই মানবিকতার গল্প এখন হাসপাতালের প্রতিটি রোগী ও স্বজনদের মুখে মুখে। তারা বলেন, এই নারী এগিয়ে না এলে ছেলেটিকে সুস্থ করা সম্ভব হতো কিনা সন্দেহ রয়েছে।

লাকি আলম বলেন, ছেলেটি এখন আগের চেয়ে অনেক সুস্থ। তবে মা আর আল্লাহ ছাড়া সে কোন কথা বলে না। তার আরও উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। তার অনুরোধে হাসপাতালের সমাজসেবা বিভাগ প্রেসক্রিপশন প্রদর্শন স্বাপেক্ষে মাঝে মধ্যে ওষুধ কিনে দিচ্ছেন। কিন্তু ছেলেটির উন্নত খাবার প্রয়োজন। লাকি নিজের অর্থে দুধ,ডিম কিনে খাওয়াচ্ছেন। কিন্তু তার একার সামর্থ্যে ছেলেটিকে সুস্থ করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন তিনি। এজন্য সরকারী প্রতিষ্ঠানসহ সামর্থবানদের ছেলেটিকে বাঁচাতে এগিয়ে আসার অনুরোধ জানান তিনি।

হাসপাতালের জরুরী বিভাগের রেজিষ্ট্রি খাতা ঘেটে দেখা যায় গত ২০ অক্টোবর সকাল ৫ টা ২০ মিনিটে ছেলেটি অজ্ঞাত নামা হিসাবে ভর্তি দেখানো হয়েছে। তবে কে বা কারা তাকে ভর্তি করেছেন তার কোন তথ্য নেই খাতায়।

মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃলুৎফর রহমান জানান, ছেলেটির মাথা ও হাতে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন ছিলো। মাথায় কয়েকটি সেলাই দেয়া হয়। বৃহস্পতিবার মাথার সেলাই কাটা হয়েছে। তার অবস্থা আগের চেয়ে অনেক ভালো। তবে আরও উন্নত চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু কোন আত্বীয়-স্বজন না থাকায় তাকে ঢাকায় পাঠাতে পারছেন না। সাধ্যমতো এখানেই চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তবে দ্রুত তাকে ঢাকায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান তিনি।

মানিকগঞ্জ সদর থানার অফিসার ইনচার্জ রকিবুজ্জামান জানান, হাসপাতালে জখম হওয়া অজ্ঞাত কোন শিশু ভর্তি রয়েছে-এমন খবর তার জানানেই। এ বিষয়টি খোঁজ খবর নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে বলে জানান তিনি।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply