গরুর খামার বদলে দিলো লাকির ভাগ্য

|

ঝিনাইদহ প্রতিনিধি:

নিঃসন্তান বিধবা নারী আম্বিয়া খাতুন লাকি। সমাজের হাসি-ঠাট্টা আর কটূকথা দমাতে পারেনি স্বপ্ন বাজ অদম্য এই নারীকে। মাত্র ৪টি গাভী নিয়ে শুরু করেন স্বপ্ন বোনা। ৪ বছরের ব্যবধানে খামারে গাভীর সংখ্যা ৪০টির বেশি। সংগ্রামী জীবনে হোঁচট খেয়েও মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো যায় তারই প্রমাণ দিয়েছেন তিনি। কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে “ডেইরি আইকন” পদকে ভূষিত হয়েছেন। শুধু গাভীর খামার নয় তার বাড়িজুড়ে রয়েছে অর্থনীতির গল্প। ওই গ্রামে লাকির দেখাদেখি প্রায় ১৫টি খামার গড়ে উঠেছে। ছাগল, হাঁস-মুরগি, কবুতর-পাখিসহ আছে বিভিন্ন ধরনের গৃহপালিত পশুপাখি।

৫ বোন আর ১ ভাইয়ের মধ্যে দ্বিতীয় লাকি। এসএসসি পাশ করার পর ২০০৫ সালে বিয়ে হয় লাকির। দুঃখের বিষয় হলো ২০০৮ সালে তার স্বামীর ব্রেন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ভারতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে সেখানেই মারা যান। এরপর স্বামীর বাড়িতে জায়গা হয়নি তার। বাবার বাড়িতে কয়েক বছর থাকার পর পারিবারিক সমস্যার পর মান-অভিমান করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান। এরপর ২০১২ সালে লেবাননে চলে যায়। ২০১৮ সালে দেশে ফিরে গোড়ে তোলেন এই গাভীর খামার। ২০২১ সালে দেশে ৪০ জন খামারী ডেইরি আইকন নির্বাচিত হন। আম্বিয়া ৫ম হয়েছেন। আর খুলনা বিভাগের মধ্যে হয়েছেন প্রথম। ১ লাখ টাকার চেকসহ পেয়েছেন অনেক পুরস্কার। দুধ, ঘি, মাখন ও গরু বিক্রি করে মাসে প্রায় ২ লাখ টাকা আয় করেন লাকি। বিভিন্ন সেবামূলক কাজে অংশ নিয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করায় এবার ইউপি নির্বাচনে নারী সদস্যও নির্বাচিত হয়েছেন তিনি।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খামারের সমস্ত কাজের তদারকি আম্বিয়া খাতুন লাকি নিজেই করে থাকেন। বুঝিয়ে দেন খামারের ৪ জন কর্মচারীর সকল কাজকাম। গ্রামের মানুষ, জনপ্রতিনিধিসহ সবার কাছেই লাকি এখন প্রশংসার পাত্র। দেশের ডেইরি আইকন নির্বাচিত হওয়ায় গাভীর খামার দেখতে প্রতিদিন অনেক মানুষ তার খামার দেখতে আসছেন। লাকির একটিই স্বপ্ন, তার খামারে গাভীর সংখ্যা ১’শতে উন্নীত করা এবং দেশের সফল নারী উদ্যোক্তা হওয়া।

খামারে কাজ করতে যাওয়া নারীরা জানান, বাড়ির পাশেই লাকির খামার। তারা প্রতিদিন সকালে বাড়ির কাজ শেষ করে খামারে আসে। সকাল থেকে শুরু হয় খামারটি পরিস্কার করা, গরুকে গোসল করানো, দুধ দোয়ানো, খেতে দেওয়া, খাস কাটাসহ নানা কর্মযোগ্য। এরমাঝে নিজেদের বাড়ির কাজও সেরে আসেন তারা।

লাকির ভাই বউ জানান, লাকি আপার কাজে প্রতিদিন সহযোগিতা করতে হয়। সকালে গরুর দুধ দোহানো থেকে শুরু করে দুধ থেকে মাখন এবং ঘি তৈরি কাজও করতে হয়।

সাগান্না ইউপি সদস্য আলী আকবর জানান, একজন নারী হয়ে লাকি যা করছেন তাতে এলাকাবাসী গর্বিত। তিনি মেম্বার হিসেবেও ইতোমধ্যে অনেক সুনাম কুড়িয়েছে।

তিনি আরও বলেন, প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন (এলডিডিপি) প্রকল্প থেকে দুধ দোহানোর মেশিন ও মাখন সেপারেটের মেশিন দিয়েছে। প্রতিদিন প্রায় ১০ কেজি মাখন হয়। সেগুলো জ্বালিয়ে ৪-৫ কেজি ঘি তৈরি হয়। মাখন তোলার পর দুধগুলো মিষ্টির দোকানে বিক্রয় করেন। এছাড়াও গোবর দিয়ে বায়োগ্যাস তৈরি করে জ্বালানির চাহিদা মেটাচ্ছেন।

ইউপি সদস্য বলেন, উদ্যোক্তা হিসেবে সহজ শর্তে ব্যাংক লোন আর খামারের আয় থেকে দুইটি বিশাল মার্কেট ও একটি বাড়ি নির্মাণ করেছেন।

লাকি জানান, ঝিনাইদহ সদর উপজেলার সাগান্না ইউনিয়নের ২নং বাদপুকুরিয়া ওয়ার্ডে ১ বছর আগে বিপুল ভোটে সংরক্ষিত ইউপি সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। ঝিনাইদহ জেলাতে নারী উদ্যোক্তা পুরস্কার এবং নারী উদ্যোক্তা হিসেবে জয়িতার প্রথম পুরস্কার পেয়েছেন।

ঝিনাইদহ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মনোজিৎ কুমার সরকার বলেন, নারীর ক্ষমতায়নসহ গ্রামীণ অর্থনীতিতে আম্বিয়া খাতুন লাকি একজন আইকন, তার দেখাদেখি গ্রামাঞ্চলের অনেকেই এখন খামারী, গাভী পালন, গরু মোটাতাজাকরণ করছে।

তিনি বলেন, জেলায় ক্ষুদ্র-মাঝারিসহ খামার রয়েছে ৬ শতাধিক। তার মধ্যে নারী হিসেবে লাকির ফার্মটি সবথেকে বড়। তারা নিয়মিত লাকির খামার পরিদর্শন করেন। সেই সাথে তাকে সার্বিক সহযোগিতা করে থাকেন। এছাড়াও প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পসহ বিভিন্ন প্রকল্পে নারীদের অগ্রাধিকারসহ সহায়তা করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

এটিএম/


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply