রংপুরে নির্যাতনে অন্তঃস্বত্ত্বা তরুণীর মৃত্যুর অভিযোগ: সাড়ে ৬ মাস পর লাশ উত্তোলন

|

স্টাফ করেসপনডেন্ট, রংপুর:

রংপুরে দাফনের ৬ মাস ১৯ দিন পর আদালতের আদেশে কবর থেকে এক তরুণীর লাশ উত্তোলন করা হয়েছে। অভিযোগ, মৃত্যুর সময় অন্তঃস্বত্বা ছিলেন ওই তরুণী। কিন্ত, তিনি গর্ভপাতে রাজি না হওয়ায় হত্যার পর তার মুখে বিষ ঢেলে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে তড়িঘড়ি করে লাশ দাফন করানোর ব্যবস্থা করেছিল প্রেমিক জিয়াদ ও তার পরিবার। সিআইডি জানিয়েছে পোস্টমোর্টেম প্রতিবেদনের পর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

সোমবার (২০ মার্চ) সকালে তার লাশ উত্তোলন করে ময়নাতদন্ত শেষে সন্ধ্যায় আবারও দাফন করা হয়।

এ প্রসঙ্গে, রংপুর সিআইডি পরিদর্শক সামসুল ইসলাম জানান, স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ির পর রংপুর মহানগরীর পূর্ব খাসবাগ এলাকার একটি ভাড়া বাড়িতে কন্যা বর্ষা ও পুত্র বাঁধনকে রেখে ঢাকায় ঢাকা পাসপোর্ট অফিসে আয়ার কাজ করতেন সাহিনা বেগম। গত বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি ওই বাসাতেই মারা যায় বর্ষা। এ ঘটনায় একটি ইউডি মামলা করে থানা পলিশ। পরে দেয়া হয় ফাইনাল রিপোর্ট। কিন্তু পরবর্তীতে বর্ষার মা একই এলাকার রিপন মিয়ার ছেলে জিয়াদ হোসেনসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনালে ধর্ষণ ও হত্যা মামলা দায়ের করেন। আদালত মামলাটি তদন্তের ভার দেয় সিআইডিকে। সিআইডি তদন্ত শুরু করলে দেখা যায়, লাশ পোস্টমোর্টেম না করেই দাফন করা হয়েছে।

এরপর, আদালতের আদেশে রংপুর জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মলিহা খানমের উপস্থিতিতে সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টায় লাশ কবর থেকে উঠিয়ে ময়নাতদন্তের জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। সেখানে ময়নাতদন্ত শেষে সন্ধ্যায় আবারও লাশ দাফন করা হয়।

সিআইডির এ কর্মকর্তা আরও জানান, বর্ষার মোবাইলে তার ও জিয়াদের কনভারসেশন, ভিডিও, অডিও ক্লিপ ইত্যাদি আমরা জব্দ করেছি। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর আমরা চার্জশিট দাখিল করবো। মেয়েটি অন্তঃসত্বা ছিল কি না, তাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে কি না কিংবা গর্ভপাত ইস্যুতে তাকে অত্যাচার করে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করা হয়েছে কি না, সবকিছুই আমরা তদন্ত করছি। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এলেই সব জানা যাবে।

এ প্রসঙ্গে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মলিহা খানম জানান, আদালতের নির্দেশে আমার উপস্থিতিতে লাশ উত্তোলন, ময়নাতদন্ত ও পুনরায় দাফন সম্পন্ন হয়েছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনের পর বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে বলা যাবে। তদন্তে কোনো গাফিলতি হবে না।

নিহত বর্ষার মা সাহিনা বেগম জানিয়েছেন, আমি ঢাকায় চাকরি করার সময় ফোনে বর্ষা আত্মহত্যা করেছে বলে খবর পাই। ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে জিয়াদের পরিবার ও পুলিশও জানায় যে সে আত্মহত্যা করেছে। তখন আমি উপায়ন্তর না পেয়ে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফনের অনুমতি দেই। দাফনের পর আমি আমার মেয়ের মোবাইল ফোনে জিয়াদের সাথে কথপোকথন ও তাদের অন্তঃরঙ্গ মুহূর্তের বিভিন্ন ছবি দেখতে পাই। তখন মোবাইলটি সেখানে আসা এসআই গনেশ চন্দ্রকে দেয়া হয়েছিল। এরইমধ্যে আমি জানতে পারি যে ভাড়াটিয়ার নাতি জিয়াদের সাথে আমার মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাদের শারীরীক মেলামেশার প্রেক্ষিতে আমার মেয়ে ৫মাসের অন্তঃস্বত্বা হয়। তখন জিয়াদ ও তার পরিবার বর্ষাকে গর্ভপাত করানোর জন্য চাপ দেয়। যারা আমার মেয়েকে গোসল করিয়েছেন তারাও জানান, আমার মেয়ের পিঠে অনেক আঘাতের চিহ্ন ছিল এবং সে অন্তঃস্বত্বা ছিল। কিন্তু জিয়াদ ও তার পরিবার সে সময় বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে পুলিশের সহযোগিতায় দ্রুত ঘটনাটিকে আত্মহত্যা হিসেবে চালিয়ে দাফনের ব্যবস্থা করে। বিষয়গুলো জেনে আমি ৩ দিন পর থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। বরং আমার মেয়ের মোবাইল পুলিশের কাছ থেকে এনে দেখি সেখান থেকে সব ছবি ডিলিট করা হয়েছে। পরে আমি বিষয়টি স্থানীয় কাউন্সিলরকে জানাই। তিনিও কোনো সুরাহা দেন নি। মাস দেড়েক পর আমি আদালতে মামলা করি।

সাহিনা বেগম আরও জানান, আমার মেয়ে গর্ভপাতে রাজি না হওয়ার কারণে তাকে নির্যাতন করে হত্যার পর মুখে বিষ ঢেলে দেয়া হয়েছে। জিয়াদ ও তার পরিবার ঘটনাটি ধামাচাপা দিতেই পুলিশের সহযোগিতায় লাশ তড়িঘড়ি করে দাফন করেছে। এখন এর উপযুক্ত বিচার আমি চাই।

নিহত বর্ষার খালা পারুল বেগম (৪০) জানান, বর্ষার মৃত্যুও খবর পেয়ে যখন আমরা ঘটনাস্থলে যাই। তখন উল্টা পুলিশ বলে যে মা, ছেলে ও খালারা মিলে বর্ষাকে হত্যা করেছে। ওদের হ্যান্ডকাফ লাগাও। তখন আমরা আর কোনো কথাই বলতে পারি নি। ওরা বর্ষার লাশ দাফন করেছে। কিন্তু জিয়াদের সাথে যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল, ৫ মাসের গর্ভবতী ছিল বর্ষা, গর্ভপাতের জন্য তার ওপর টর্চার চলছিল- এগুলো আমরা সবাই জানি।

তবে ঘটনার দিন লাশ দাফনের সময় উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তা মেট্রোপলিটন কোতয়ালী থানার এসআই গণেশ চন্দ্র জানান, তাৎক্ষণিকভাবে বর্ষার পরিবারের দাবিতেই ময়নাতদন্ত না করে দাফনের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। তখন বর্ষার মায়ের কোনো অভিযোগ ছিল না। এছাড়াও আমরা একটি মোবাইল জব্দ করেছিলাম। ঠিক সেভাবেই দিয়েছি। কোনো কিছুই ডিলিট করা হয়নি। যদি ডিলিট করাে হতো তাহলে ভিডিও, ওডিও ও কনভারসেশন কীভাবে পাওয়া গেলো? ঘটনার সময় একটি ইউডি মামলা দায়ের হয়েছিল বলেও জানান এসআই গণেশ।

নহত বর্ষার খালাতো ভাই সামিউর রহমান সবুজ জানান, সেদিন যখন পুলিশ মোবাইল নিয়ে যায়, তার আগে আমি মোবাইলের কথোপকথনের স্ক্রিনশট, অডিও ও ভিডিওগুলো আমার মোবাইলে ট্রান্সফার করে নেই। কিন্তু পুলিশ যেদিন মোবাইল ফেরত দেয় সেদিন আর ওগুলো ছিল না। পরবর্তীতে আমরা স্নাপচ্যাট ও ড্রাইভ থেকে আবারও রিকভার করে সেগুলো মামলার সাথে সিডি ড্রাইভ আকারে যুক্ত করে দিয়েছি। এছাড়া সিআইডিকেও সব সিডি করে দেয়া হয়েছে। পুলিশ কেনো এমনটা করেছে সেটা আমরা জানি না।

এদিকে, বর্ষার রহস্যজনক মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ তার স্বজন ও এলাকাবাসী। প্রকৃত ঘটনা উম্মোচন ও দোষীদের শাস্তি চান তারা।

বর্ষার খালাতো ভাাই আতিকুল ইসলাম, প্রতিবেশী, জাহেদা খাতুন ও আকলিমা বেওয়া জানান, এ ঘটনার সঠিক বিচার হতে হবে। তা না হলে মেয়েরা নিরাপদ থাকতে পারবে না।

লাশ উত্তোলনের সময় উপস্থিত বর্ষার খালা সালমা বেগম জানিয়েছেন, সিআইডি যখন লাশ উত্তোলন করার জন্য যায়, তখন এ ঘটনায় করা মামলার ৪ নম্বর আসামি সিরাজ উদ্দিন ডোম পরিচয়ে কোদাল নিয়ে কবরস্থানে আসেন। কীভাবে একজন আসামি কবরস্থানে আসে ও নিজেকে ডোম পরিচয় দিয়ে কবর খোড়ে, তাতে তাদের কি উদ্দেশ্য এটা আমরা বুঝতে পারছি না। আমরা ঘটনার সঠিক ও নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে জিয়াদসহ জড়িতদের ফাঁসির দাবি জানাই।

মামলার ৪ নং আসামির কবরস্থানে উপস্থিত হওয়ায় ব্যাপারে জানতে সিআইডির পরিদর্শক সামসুল ইসলামের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওযা যায়নি।

/এসএইচ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply