নির্বাচন সুষ্ঠু করতে ক্ষমতাসীন বা বিরোধী দল ক্ষতিগ্রস্ত হলে করার কিছু নেই: মো. সাহাবুদ্দিন

|

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।

‘কাউকে অবদমিত করতে নয়, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে আমি আমার ক্ষমতা প্রয়োগ করবো। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দায়িত্ব পালনে যদি ক্ষমতাসীন বা বিরোধী দল ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে আমার করার কিছু নেই। আমি চাই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন’— বলছিলেন নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।

দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে সোমবার (১৩ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে মো. সাহাবুদ্দিনের নাম ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনের প্রজ্ঞাপন জারির পর যমুনা টেলিভিশনের মুখোমুখি হন নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান। তার সাক্ষাৎকার নেন যমুনা নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শাকিল হাসান। এ সময় তিনি এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারে উঠে আসে নব রাষ্ট্রপতির ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ, ছাত্র ও যুব রাজনীতির ইতিহাস এবং দেশ নিয়ে ভাবনার কথা।

প্রশ্ন করা হয়, সব দলের অংশগ্রহণে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজনে কোনো উদ্যোগ নেবেন কিনা? বললেন, সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন সারা বিশ্ব চায়, জনগণ চায়। সবাইকে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। সরকারের দায়িত্ব কী? দায়িত্ব হলো, যেসব ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, সে ক্ষমতার মধ্যে থেকে যেন সকল দায়িত্ব পালন করা। এরমাঝে কখনও রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপের দায়িত্ব পড়ে। জাতীয় দুর্যোগ ও নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিলে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে নির্বাচনের পরিবেশটাকে নষ্ট করা হলে তখন কিছু কিছু কাজ করার থাকে। আমি তখন পিছপা হবো না। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। এক্ষেত্রে আমার যে ভূমিকা তা রাখবো। একটা ন্যায়ভিত্তিক কর্মসূচির মাধ্যমে আমি আমার ক্ষমতাকে প্রয়োগ করবো। যাতে সেখানে পক্ষপাতিত্বের কোনো চিহ্নও না থাকে। মানুষ যেন উপলব্ধি করতে পারে, রাষ্ট্রপতি যে কাজ করেছে তা দেশের জন্যই করেছে; তা যদি প্রয়োজন হয়।

সাক্ষাৎকারের শুরুতেই মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার বিষয়ে জানতে চান প্রতিবেদক। তিনি বললেন, পত্র-পত্রিকায় দেখতাম, সব জায়গায় খোঁজ পেতাম, আমি তো আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, প্রচার ও প্রকাশনা কমিটির চেয়ারম্যান ছিলাম, মাঝেমধ্যে দলীয় কার্যালয়ে যেতাম, অনেক আলাপ-আলোচনা হতো; কিন্তু রাষ্ট্রপতি হবো এটা আঁচ করতে পারিনি।

তিনি আরও বলেন, প্রফেশনাল জীবনের আগে আমি রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলাম। এটা তো সত্য, তা লুকানো যাবে না। কেননা, আমি ছাত্রলীগের সভাপতি (পাবনা জেলা) ছিলাম। স্বাধীনতার পূর্বে ৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন করেছি। ৬৯-এ ১১ দফা আন্দোলন করেছি। পাবনায় ভুট্টা আন্দোলন নামে একটা আন্দোলন হয়েছিল। অনেকে সাঁওতাল বিদ্রোহের কথা জানেন। কিন্তু ভুট্টা আন্দোলনের কথা জানেন না। আইয়ুব-ইয়াহিয়ার রেশনে দেয়া ভুট্টা খেয়ে দুই-তিন জন মারা যায়। তখন আমরা সশস্ত্র বিদ্রোহ করেছিলাম। ওই সময় রাজনীতির সাথে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলাম। তখন বঙ্গবন্ধুর স্বাধিকারের সংগ্রাম অথবা বঙ্গবন্ধুর স্বায়ত্তশাসনের দাবির প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছি। ছাত্র রাজনীতি, আন্দোলন সংগ্রামের পাশাপাশি পড়াশোনাও করেছি। মুক্তিযুদ্ধেও অংশ নিই। যুদ্ধের পর আমি যুবলীগের সভাপতি (পাবনা জেলা) হই।

বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) প্রসঙ্গেও সাক্ষাৎকারে কথা হয়। মো. সাহাবুদ্দিন বললেন, এখন তো মহামান্য হওয়ার পথে… অনেক কথা আছে, যেগুলো সত্য কথা। কিন্তু মুখে বলা যায় না। তবে আজকে যারা বাকশাল বলে গালিগালাজ করে, তাদের নেতা যিনি ছিলেন তিনি কিন্তু বাকশালের সদস্য হতে বঙ্গবন্ধুর কাছে আবেদনপত্র নিয়ে গিয়েছিলেন। তাহলে এ কথা তো স্বীকার করতে হবে, বঙ্গবন্ধুর বাকশালের কর্মসূচি ছিল জনমুখি ও গণমুখি। অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য এ কর্মসূচি দিয়েছিলেন তিনি। পাবনায় আমাকে বাকশালের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এটা আমার সৌভাগ্য। ১৯৭৫ সালের জুনে বঙ্গভবনে উনার সাথে আমার শেষ দেখা হয়। সেদিন তিনি বলেছিলেন, বাকশাল এমন একটি প্ল্যাটফর্ম, যেটি কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র, যুবক, আইনজীবী, পেশাজীবি থেকে শুরু করে সর্বস্থরের মানুষের। একটি কর্মসূচির মাধ্যমে ধীরে ধীরে সাবলম্বী করে গড়ে তুলতে হবে।

নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন শাকিল হাসান।

প্রশ্ন ছিল, বাংলাদেশে প্রতিহিংসার রাজনীতির যে চর্চা তা কীভাবে মোকাবেলা করবেন তিনি? বললেন, আমরা ঐক্যবদ্ধ জাতি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলতে অনকে লজ্জাবোধ করে। স্বীকৃত বিষয় নিয়ে যদি অনীহা প্রকাশ করে, তাহলে তো ঐক্য সম্ভব নয়। কিন্তু জাতীয় ঐক্যের তো প্রয়োজন। একপক্ষ তো আরেক পক্ষকে পৃথিবী থেকে উজাড় করে দিতে চায়; যেমন ১৫ ও ২১ আগস্টের ঘটনা। এ ধরনের নির্মমতার কথা আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় ভাবতে পারিনি। এমন অভিজ্ঞতা যখন আমাদের হয়েছে, তখন থেকে আমাদের উচিত ছিল, ঘাতকদের বিচার করা। কিন্তু ইনডেমনিটি দেয়া হলো। প্রমোশন ও বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া, তাতে কী তারা এই হত্যার অংশীদার নয়? রাষ্ট্রপতির চেয়ার বসতে যাচ্ছি, এটা হয়তো বলা উচিত হবে না। কিন্তু যেটা মনে করি তা তো বলতে হবে। আমার মুখে সত্য ঘটনা বলতে কোনো আপত্তি নেই। আমি বলবো, আমি যেটা বিশ্বাস করি সেটা বলবো। ইনডেমনিটি দেয়া, তাদের রক্ষার চেষ্টা করা— সভ্য দেশে এসব গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এরপর ২১ আগস্টের যে ঘটনা, তাতে তারা কী চেয়েছিল? মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি স্বাধীনতাকে মানতে পারে না। পাকিস্তানের ভাবধারায় চলে যেতে চেয়েছিল।

জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার বিষয়ে মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, যে দেশে এমন মানসিকতা (১৫ ও ২১ আগস্টের ঘটনা ঘটানোর) আছে, সেখানে যারা চিন্তাবিদ আছেন, সমাজের কথা ভাবেন, সমাজতন্ত্রের কথা ভাবেন, তারা কিংবা ঐশ্বরিক শক্তি কোনো ফর্মূলা দিতে পারবে না এ নিয়ে। এমনকি, ২০০১ সালে নির্বাচন পরবর্তী যে সহিংসতা হয়েছিল তা মানবাধিকার অপরাধ। ২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়জয়কারের পর এটার প্রতিশোধ নিতে পারতেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। কিন্তু তিনি তা করেননি, মানা করেছেন। প্রতিশোধের রাজনীতি করেননি তিনি। বঙ্গবন্ধু কন্যা একসাথে রাজনীতি করার আহ্বান জানান। কিন্তু আসে না তো। পিজি হাসপাতালের নাম পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়েছে। কিন্তু তারা নাম নেয় না। পিজি হাসপাতাল বলে।

ঐক্যবদ্ধের জন্য আপনি কী নতুন কোনো উদ্যোগ নেবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, আমি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে রাজনীতি করি। দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ আমাকে যে মহান দায়িত্ব দিয়েছে, তাতে আমার প্রথম কাজ কাজ হলো, জাতীয় বিভেদকে ঐক্যে পরিণত করা। আমি চেষ্টা করবো। আমার কোনো ঐশ্বরিক শক্তি নেই। আমি মনে করি, দেশের অগ্রগতির জন্য একদিন এটা হতেই হবে। সংঘাত নয়, সমঝোতার মাধ্যমে দেশ গড়ার কাজে এগিয়ে আসতে হবে। এটা এখন চ্যালেঞ্জ।

১২তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার দায়িত্বের বিষয়ে আরও বলেন, এই মুহূর্তে আমার সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো, আগামী জাতীয় নির্বাচন নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করা। সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করে বিশ্বকে বার্তা দেয়া। সংবিধানের বাইরের দাবি তুলে সেটা সম্ভব নয়। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে। সংবিধানের মধ্যে থেকে সকল রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচন ব্যবস্থায় অংশ নিতে হবে। তখন স্বাধীন নির্বাচন কমিশন তার পুরো দায়িত্ব পালন করবে। নির্বাচনকালীন সময়ে রাষ্ট্রপতির কিছু কিছু দায়িত্ব আছে। তখন নির্বাচন করতে যেসব অন্তরায় সৃষ্টি হয়, তা দূর করা এবং নির্বাচনের পরিবেশটা সুষ্ঠু রাখা। নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন। নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা আছে বলেই তো গাইবান্ধার উপনির্বাচন বন্ধ করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ কিছু বলেনি। সংঘাতে না গিয়ে জানমালের ক্ষতি না করে যদি সুষ্ঠু নির্বাচন করা যায়, তাহলে এ দেশের মঙ্গল হবে এবং জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হবে। মানুষ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দিকে এগোবে। আর শক্তিশালী একটি সরকার গঠিত হবে।

/এমএন


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply