ইউএনওর কাণ্ড, এক ইউপিতে দুই চেয়ারম্যান!

|

লক্ষ্মীপুর প্রতিনিধি:

অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে লক্ষ্মীপুরে এক ইউপি চেয়ারম্যান বহিস্কৃত হওয়ায় শূণ্য পদে পৃথক চিঠি ইস্যু করে দুই সদস্যকে (মেম্বার) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এতে দায়িত্ব পালন নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে জটিলতা। দেখা দিয়েছে ওই দুই ইউপি সদস্যের মধ্যে পারস্পারিক দ্বন্দ্ব্যও। তাদের দুজনই এখন নিজেদেরকে ইউপি চেয়ারম্যান দাবি করছেন। এ নিয়ে পরিষদের অন্যান্য সদস্য ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মাঝে প্রশাসনিক জটিলতাসহ মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এমন জটিলতায় পড়েছে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার ৫নং পার্বতীনগর ইউনিয়ন পরিষদ।

জানা গেছে, অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গত ২২ জানুয়ারি পার্বতীনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ওহিদুর রহমানকে বহিষ্কার করে তার পদটি শূণ্য ঘোষণা করেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইমরান হোসেন। এর আগে, এ ইউনিয়ন পরিষদের কোনো প্যানেল চেয়ারম্যান নির্বাচিত না হওয়ায় ওই ইউপির দাপ্তরিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে স্থানীয় নগরিকদের সেবাপ্রদান ও ইউপির চলমান বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গত ২৪ জানুয়ারি (স্মারক নং-৭৩) ইউপি সদস্য মো. কামরুজ্জামানকে প্যানেল চেয়ারম্যান-১, ইউপি সদস্য মাইনউদ্দিন ভূঁইয়া ময়ূরকে প্যানেল চেয়ামরম্যান-২ ও সংরক্ষিত ইউপি সদস্য (মহিলা) ইশরাত জাহান ফারজানাকে প্যানেল চেয়ামরম্যান-৩ হিসেবে উল্লেখ করে প্যানেল চেয়ারম্যান গঠন করে প্রথমে একটি চিঠি ইস্যু করেন সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। একই সাথে (স্মারক নং-৭৪) মো. কামরুজ্জামানকে পার্বতীনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের শূণ্য পদে দায়িত্ব পালনের জন্য স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন ২০০৯ এর ৩৪ ধারার উপধারা-২ এর ক্ষমতাবলে একটি লিখিত প্রজ্ঞাপন জারি করেন ইউএনও।

এদিকে, আবার দুইদিনের মাথায় আগের প্যানেল চেয়ারম্যান-১ মো. কামরুজ্জামানকে বাদ দিয়ে ২৬ জানুয়ারি পুনরায় একই ইউনিয়ন পরিষদে (স্মারক নং-৮৯) ইউপি সদস্য মো. মাইনউদ্দিন ময়ূরকে প্যানেল চেয়ারম্যান-১, ইশরাত জাহান ফারজানাকে প্যানেল চেয়ামরম্যান-২ ও মাইন উদ্দিন ভূঁইয়াকে প্যানেল চেয়ামরম্যান-৩ উল্লেখ করে আরেকটি চিঠি ইস্যু করেন। একই সময় ভিন্ন আরেকটি স্মারকে (স্মারক নং-৯০) মো. মাইন উদ্দিন ময়ূরকে চেয়ারম্যানের শূন্য পদে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দিয়ে পুনরায় আরেকটি প্রজ্ঞাপন জারি করেন ইউএনও। এতে ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন নিয়ে দুই জনপ্রতিনিধির মধ্যে চরম দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দার অভিযোগ, পার্বতীনগর ইউনিয়ন পরিষদ নিয়ে জনপ্রতিনিধিরা সাপলুডু খেলায় মেতেছেন। এক চেয়ারম্যান অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে বহিষ্কার হয়েছেন। এখন সেই চেয়ারম্যান পদ নিয়ে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু হয়েছে। কামরুজ্জামান নামে এক ইউপি সদস্যকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের জন্য নির্দেশ দিয়েছে ইউএনও। কিন্তু দু’দিনের মাথায় ওই প্রজ্ঞাপন বাতিল না করে ক্ষমতাসীন দলের দাপট দেখিয়ে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক (ইউপি সদস্য) মাইনউদ্দিন ময়ূর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বনে যায়। এতে সময়ক্ষেপন ও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে সেবা প্রার্থীদের।

ইউপি সদস্য ও প্যানেল চেয়ারম্যান-১ মো. কামরুজ্জামান বলেন, গত ২৪ জানুয়ারি প্যানেল চেয়ারম্যান গঠনের পর প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমাকে ইউপি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন ইউএনও। এরপর থেকে বিভিন্ন জন্মনিবন্ধন, নাগরিকত্বসহ বিভিন্ন সনদে স্বাক্ষর করি। এবং জণগনকে সেবা দিয়ে আসছি। কিন্তু হঠাৎ করে গত ২৯ জানুয়ারি ইউপি সদস্য মাইন উদ্দিন ময়ূর ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে আরেকটি চিঠি এনে নিজেকে চেয়ারম্যান দাবি করছেন। কিন্তু আমাকে দায়িত্ব পালন স্থগিতের জন্যও ইউএনও কোন চিঠি দেয়নি। এটা কিভাবে সম্ভব, একই ইউনিয়নে দুজন চেয়ারম্যান! এ ঘটনায় জনগনের সেবা নিশ্চিতের লক্ষ্যে ২৬ তারিখ উল্লেখিত প্রজ্ঞাপনটি বাতিলের দাবি জানান তিনি।

এদিকে, নতুনভাবে ইস্যুকৃত প্যানেল চেয়ারম্যান-১ ও ইউপি সদস্য মাইন উদ্দিন ময়ূর বলেন, গত ২৬ জানুয়ারি ইস্যূকৃত চিঠির বিষয়টি ২৯ জানুয়ারি জানতে পারি। এরপর ৩১ জানুয়ারি পরিষদের দায়িত্ব গ্রহণ করি। তবে পূর্বে দায়িত্ব দেওয়া মো. কামরুজ্জামানকে কেনো কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়নি সে বিষয়ে কিছুই জানেন না তিনি। তবে তিনিও জানান, এক ইউপিতে দুইজন চেয়ারম্যান রয়েছেন এমন কথা তিনি কোথাও শোনেননি।

পার্বতীনগর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মো. তসলিম উদ্দীন বলেন, প্যানেল চেয়ারম্যান-১ মো. কামরুজ্জামানকে দায়িত্ব দেয়ার পর ওনার নামে সিল ও প্রয়োজনীয় সব কিছু তিনি পরিষদে তৈরি করেছেন। কিন্তু, হঠাৎ করে ২৯ জানুয়ারি আমাকে ডেকে নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরেকটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ইউপি সদস্য মাইনউদ্দিনের ময়ূরকে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের জন্য একটি প্রজ্ঞাপন জারির চিঠি দেন। সে আলোকে মাইনউদ্দিন ময়ূর দায়িত্ব পালন করবেন। তবে, পূর্বের কামরুজ্জামানের নির্দেশটি বাতিল না করার বিষয়ে জানতে চাইলে ইউএনওর রোষানলে পড়তে হয়েছে বলেও জানান তিনি।

এদিকে, লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইমরান হোসেন বলেন, ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের শূন্য পদে কামরুজ্জামানকে দায়িত্ব দেয়া হলে, ইউনিয়ন পরিষদের বাকি সদস্যরা প্যানেল চেয়ারম্যান-১ কামরুজ্জামানকে অনাস্থা দেবেন বলে স্থানীয় সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট নুরউদ্দিন চৌধুরীকে মৌখিকভাবে জানান। পরে ওই সংসদ সদস্যের ডিউ লেটার প্রাপ্তির মাধ্যমে প্যানেল চেয়ারম্যান পুনঃগঠন করে ইউপি সদস্য মাইনউদ্দিন ময়ূরকে ওই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয়।

পূর্বের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্যানেল চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব স্থগিতের জন্য কোনো চিঠি ইস্যু করা হয়েছে কিনা- জানতে চাইলে ইউএনও বলেন, এমপির নির্দেশ মোতাবেক পুনঃগঠন করা হয়েছে। এতে অনিয়ম হয়নি। তবে স্থানীয় সংসদ সদস্যের ডিউ লেটারের মাধ্যমে প্যানেল চেয়ারম্যান-১ পুনঃগঠন করা যায় কিনা এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে তিনি সংবাদকর্মীদের সাথে রূঢ় আচরণ করেন।

প্রসঙ্গত, সদর উপজেলার পার্বতীনগর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান ওয়াহিদুর রহমানের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে অনাস্থা দেন ইউপি সদস্যরা। এর প্রেক্ষিতে, গত ২২ জানুয়ারি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ মোতাবেক লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রজ্ঞপন জারি করে চেয়ারম্যান পদটি শূন্য ঘোষণা করেন।

/এসএইচ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply