জীবনে ফেরার গল্প: অলির নাম শুনেই আতঙ্ক দ্বিগুণ হয়ে যেতো জেলেদের

|

সুন্দরবন বাংলাদেশের প্রাণ। ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে এই ব-দ্বীপ অঞ্চল রক্ষার প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যুহ। শ্বাপদসংকুল এ অরণ্যের ওপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে লাখ লাখ মানুষ। নিরন্তর সংগ্রাম করে চলা এই বনজীবীদের কাছে আতঙ্কের নাম একেকটি দস্যুবাহিনী। সুখের কথা, এই দস্যুবাহিনীগুলো একে একে আত্মসমর্পণ করছে, আইনের কাছে নিজেদের সোপর্দ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসছে। আর এই আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়াটিতে মধ্যস্থতা করেছেন একজন সাংবাদিক। তিনি মোহসীন-উল হাকিম। ধারাবাহিকভাবে লেখছেন তার বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্প। যমুনা অনলাইনের পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো।

জীবনে ফেরার গল্প (১৮-তম কিস্তি)

ওমুক বাহিনীতে অলি আব্বাস আছে। তাতেই জেলে বাওয়ালীদের মনের আতঙ্ক দ্বিগুণ হয়ে যেতো। দশ বছর আগে রামপালের এই তরুণ পা বাড়ায় দস্যুতায়। কিছুদিনের মধ্যে দুর্ধর্ষ দস্যু হয়ে ওঠা অলি আব্বাস আত্মসমর্পণ করে জীবনে ফিরেছে…

সেদিন প্রসাদনগরে অলি আব্বাসের বাড়ি গেলাম। রামপালের ভাগা থেকে ছোট্ট রাস্তা ধরে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছাকাছি গ্রামটি তখন বৃষ্টিতে ভেজা। ঝুম বৃষ্টির মধ্যেই পৌঁছে গেলাম সেই ছোট্ট বাড়িতে। উঠানে দৌড়ে বেড়াচ্ছে অলির কন্যা। পাশেই পোষা মোরগ-মুরগি। পুকুরে ভেসে বেড়াচ্ছে হাঁসের পাল। এই পুকুরের জমির নিয়ে বিরোধের জেরেই মামলা, আর সেই মামলার পরই দস্যুতায় নেমেছিল অলি। সেই পুকুরের পাড়ে বসেই শুনলাম গ্রামের কৈশোর পেরুনো টগবগে এক তরুণের দস্যু হয়ে ওঠার গল্প।

২০০৬ সালের কথা। পুকুরের জমি নিয়ে বিরোধ। সেই বিরোধের জের ধরেই নিজের চাচা মামলা করেন। আসামিদের একজন এই অলি আব্বাস। গ্রামের টিপিক্যাল কাহিনী। শত্রুতা করে নারী নির্যাতনসহ তিনটি মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। প্রথমবারের মতো হতে হয় ঘর ছাড়া। সবে কৈশোর পেরুনো অলি সেবারই প্রথম দস্যুতার জগতে নাম লেখায়।

পকেটে মাত্র সাতশ’ টাকা। গ্রাম সম্পর্কের মামা জিয়াদকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে বলেশ্বর পারের চরদোয়ানী। সেখান থেকে চাল, ডাল, লবণ কিনে রাতে একটি নৌকা চুরি করে বলেশ্বর পারি দিয়ে সুন্দরবন। খালের ভেতরে ভেতরে সারাদিন হেঁটে হেঁটে কাঁকড়ার নৌকায় দস্যুতা করে এক সপ্তাহে চল্লিশ হাজার টাকা জোগাড় করে তারা।

এবার লোকালয়ে এসে পঁচিশ হাজার টাকা দিয়ে ৫টি পাইপগান বানায়। তারপর ছয়জন মিলে চলে দস্যুতা। সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জে দ্রুতই নাম ছড়িয়ে পড়ে জিয়াদ বাহিনীর। তিন মাসের মধ্যেই পনের লাখ টাকা গুছিয়ে ফেলে তারা। তারপর কয়েকটি একনলা বন্দুক ও কিছু গুলি কিনে ফেলে তারা।

পরবর্তীতে টাকাপয়সার ভাগাভাগি নিয়ে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়। অলি আব্বাস ফিরে আসে লোকালয়ে। তারপর সে সময়ের সবচেয়ে বড় দস্যুদল রাজু বাহিনীতে যোগ দেয়। রাজুর সাথে শর্ত ছিলো, এক কোটি টাকা কামায় করে দিতে পারলে সেখান থেকে কিছু টাকা নিয়ে অলি বাড়ি ফিরবে। মামলাগুলো সামাল দিতে পারবে।

ততদিনে দস্যুতা বেশ রপ্ত করে ফেলেছে তরুণ সেই দস্যু। বনের ভেতরের জেলে-বাওয়ালীদের ধরে বেশি রোজগার করা যাবে না। সেই ভাবনা থেকে রাজু বাহিনীর হয়ে বড় পরিসরে সাগরে দস্যুতা শুরু করে তারা। বরগুনা থেকে কক্সবাজার.. সাগরের মাছ ধরতে যাওয়া ফিসিং ট্রলার ধরে এনে টাকা আদায় তখন থেকেই শুরু করে সুন্দরবনের দস্যুরা। সাগর থেকে জেলেদের ধরে এনে মুক্তিপণ আদায়ও চলতে থাকে। অল্প ক’দিনের মধ্যেই রাজু বাহিনী ফুলে ফেঁপে ওঠে। কিন্তু রাজু প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। এবার দশ কোটি টাকার টার্গেট নিয়ে নতুন করে দস্যুতা চালিয়ে যেতে থাকে সে। অবস্থা বুঝে সেখান থেকেই বিদায় নিয়ে বাগেরহাট পুলিশ সুপারের কাছে আত্মসমর্পণ করে অলি আব্বাস।

এরপর বিয়ে করে এলাকা ছেড়ে অন্য জায়গায় চলে যায়। এরই মধ্যে মেয়ের বাবা। এটা সেটা করে সংসার চললেও ফেরারি জীবনের আতঙ্ক পিছু ছাড়েনি। পরে আবারও দস্যুতায় নেমে পড়ে সুন্দরবনের বড় ভাই বাহিনীর সঙ্গে। আমার সঙ্গে অলি আব্বাসের প্রথম দেখা সেখানেই। এর কয়েক দিনের মধ্যেই অস্ত্র ছেড়ে নিজের জীবনে ফিরেছে সুন্দরবন দাপিয়ে বেড়ানো কুখ্যাত এই বনদস্যু।

রামপালের প্রসাদনগর গ্রামের ছোট্ট সেই বাড়িতে প্রায় দশ বছর পর ফিরে আসা। সরকার থেকে দেয়া পুনর্বাসনের টাকা সামান্য। তাই শুরুতেই ঘর ঠিক না করে, একটি মাছের ঘের নিয়েছে অলি। ঠিকঠাক মাছ পেলে দুই বছরের মধ্যে নিজের ঘরটি নতুন করে গড়তে পারবে সে। সেই আশায় এখন দিন রাত কাটছে মাছের ঘের আর ছোট্ট সংসার নিয়ে…

লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, যমুনা টেলিভিশন
যমুনা অনলাইন: এমএইচ/টিএফ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply