কপ-২৭: উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুতি ও বাংলাদেশ

|

ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ:

গ্লাসগোতে গত কপ-২৬ সম্মলনে জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে সোচ্চার ‘ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম, সিভিএফ’ এর নেতৃত্ব দানকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় বিশ্বনেতাদের সামনে চারটি দাবি তুলে ধরে।

১. শিল্পোন্নত প্রধান কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলোকে অবশ্যই কার্বন নিঃসরণের হার ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনার জাতীয় পরিকল্পনা (এনডিসি) দাখিল এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
২. উন্নত দেশগুলোকে অভিযোজন এবং প্রশমনে অর্ধেক অর্ধেক (৫০:৫০) ভিত্তিতে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে।
৩. উন্নত দেশগুলোকে স্বল্প খরচে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোতে নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব গ্রিন টেকনোলজি সরবরাহ করতে হবে।
৪. জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, খরা এবং বন্যাসহ নানাবিধ কারণে যেসব মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে তাদের দায়িত্ব উন্নত দেশগুলোকে নিতে হবে।

কপ-২৬ সম্মেলনে বাংলাদেশ জানায়, জলবায়ু পরিবর্তনে নগণ্য অবদান রাখলেও বাংলাদেশ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি। বৈশ্বিক মোট কার্বন নিঃসরণে বাংলাদেশের দায় ০.৪৭ শতাংশের চেয়েও কম। অথচ বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে জলবায়ু ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি।

এনভায়রনমেন্টাল জাস্টিস ফাউন্ডেশন বলছে, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে একটি এবং ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৫০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি হলে বাংলাদেশের ১১ শতাংশ স্থলভাগ ডুবে যাবে। এর ফলে দেশের নিম্নাঞ্চলের উপকূলে বসবাসকারী আনুমানিক ১৫ মিলিয়ন মানুষের জীবনে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে।

নভেম্বরে মিসরে বসবে কপ-২৭ সম্মেলন। সেই সম্মেলেনে বাংলাদেশ কোন বিষয়গুলো গুরুত্ব দেবে? জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে কপ-২৬ গ্লাসগোর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইসিসিএডি) পরিচালক অধ্যাপক ড. সালেমুল হক বলেন, সেখানে দুটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়,
প্রথমত, ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে সান্তিয়াগো নেটওয়ার্ক নামে পরিচিত একটি সেটআপ তৈরি করা এবং যত শিগগিরি সম্ভব এটি বাস্তবায়ন করা।

আর দ্বিতীয়টি হলো গ্লাসগোতে ক্ষয়ক্ষতির জন্য অর্থের বিষয়ে সংলাপ। বাংলাদেশসহ সিভিএফ দেশগুলো ক্ষয়ক্ষতি কমাতে কিছু পদক্ষেপ বাস্তবায়নের জন্য অর্থনৈতিক সাহায্য চেয়েছিল। মিস্টার হক মনে করেন, কার্যকর কোনো পদক্ষেপ ছাড়া বাংলাদেশের এ বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া উচিত নয়।

এছাড়া অভিযোজনের বিষয়ে তিনি বলেন, অভিযোজনের জন্য সমর্থনকে দ্বিগুণ করা দরকার এবং অভিযোজন বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে আরও দ্রুত পদক্ষেপ দরকার।

পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং গবেষণা ব্যবস্থার স্বাধীন পরামর্শক ড. হাসিব মো. ইরফানউল্লাহ মনে করেন, বাংলাদেশ সরকারের উচিত একটি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ তহবিল গঠন করা। তিনি জানান, যদি বাংলাদেশ এই জাতীয় অর্থায়ন ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে, তা হবে কপ-২৬ এর গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাংলাদেশের নেতৃত্বের জন্য একটি দুর্দান্ত মাইলফলক।
ড. হাসিব আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ নেয়ার জন্য প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানকে একটি কার্যকর উপায় হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর উচিত দুর্যোগপরবর্তী পুনর্নির্মাণ পরিকল্পনায় প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানের মাধ্যমে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনাকে অন্তর্ভুক্ত করা।

গত মার্চে পরিবেশ বিষয়ক এক আলোচনা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ সরকারের বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (জলবায়ু পরিবর্তন উইং) মো. মিজানুল হক চৌধুরী বলেছিলেন, উন্নত দেশগুলোর ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন, দেশগুলোর মধ্যে আরও ফলপ্রসূ জলবায়ু আলোচনার বিষয়ে ‘বিশ্বাস তৈরি’ করবে।
তিনি বলেন, উন্নত দেশগুলো এবং সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গমণকারী দেশগুলোকে অবশ্যই বিদ্যমান ব্যবধান কমাতে কপ-২৭ এর আগে অধিক প্রশমন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। যাতে ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রিতে সীমাবদ্ধ করা যায়। ক্ষয়ক্ষতির মোকাবিলায় সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোকে স্বচ্ছ ও সবুজ করতে উন্নত দেশগুলো থেকে উন্নত প্রযুক্তি হস্তান্তরের ওপর গুরুত্বারোপ করেন মিজানুল হক চৌধুরী।

গত ২২ আগস্ট একাদশ জাতীয় সংসদের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভায় এই সুপারিশ করা হয়। সংসদ সচিবালয় জানায়, বৈঠকে কপ-২৭ এর প্রস্তুতির সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হয়। আগামী ৬ থেকে ১৮ নভেম্বর মিসরের শার্ম এল-শেখ শহরে অনুষ্ঠেয় ২৭তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের জন্য সাইড ইভেন্টগুলো অধিক ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে আয়োজনে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করা হয়।

বাংলাদেশের জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা মনে করেন বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী নারীরা কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে তাদের কীভাবে রক্ষা করা যায়, তার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা উচিত।

/এডব্লিউ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply