মাড়সহ ভাত, সাথে সামান্য আলুভর্তা, তাও জুটছে না চা শ্রমিকদের

|

হবিগঞ্জ প্রতিনিধি:

হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার চাঁন্দপুর চা বাগানের নারী শ্রমিক আলোমনি রাজবংশী। অসুস্থ স্বামী আর দুই সন্তানের সংসার চলে তার একার আয় দিয়ে। দৈনিক ১২০ টাকা দিয়েই সারতে হয় সংসারের সব খরচ। মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে কর্মবিরতি চলায় আয় বন্ধ তার। টাকা নেই, তাই দোকান থেকে বাকি দেয়াও বন্ধ। জীবনের জন্য যে ওষুধ প্রয়োজন, কিনতে পারছেন না তাও। জানালেন, গতরাতে ঘরে যে সামান্য চাল ছিল, তাই রান্না করেছেন শুধু। তবে ভাতের মাড় ঝড়েননি আলো। তাতে ভাতের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। এই মাড়-ভাতের সাথে ছিল সামান্য আলুভর্তা। আপাতত যা জোগাতে পারছেন, তাই কোনোমতে সিদ্ধ করে গলা দিয়ে নামাতে হচ্ছে।

তবে বাচ্চাদের গলা দিয়ে নামে না এই নিরস খাবার। তারা খাবার গিলতে চায় না। তবে না খেয়ে থাকা যায় না বলেই শিশুরা কোনোমতে গিলতে বাধ্য হয়। আলোমনি জানালেন, বাগানে যখন কাজ করতেন, তখনও মজুরি পাওয়া নিয়ে ছিল নানা টালবাহানা। আর অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা তো ঠিকমতো দেয়াই হতো না।

দৈনিক মজুরি ১২০ থেকে ৩০০ টাকার করার দাবিতে হবিগঞ্জসহ দেশের সকল চা বাগানে ৯ আগস্ট থেকে ২ ঘণ্টা কর্মবিরতি শুরু করেন চা শ্রমিকরা। কিন্তু সাড়া না মেলায় ১৩ আগস্ট থেকে শুরু হয় পূর্ণদিবস কর্মবিরতি। শ্রম অধিদফতর ও মালিকপক্ষের সাথে দুই দফা বৈঠক হলেও মেলেনি সমাধান।

মালিক পক্ষ বলছে, একজন শ্রমিককে দৈনিক মজুরি, প্লাকিং বোনাস, বার্ষিক ছুটি ভাতা, বেতনসহ উৎসব ছুটি, অসুস্থতাজনিত ছুটি, ভবিষ্যৎ তহবিলে নিয়োগ কর্তার চাঁদা, কাজে উপস্থিতি অনুযায়ী বার্ষিক উৎসব ভাতা ও মোট প্রদত্ত চাঁদার ৫% প্রশাসনিক খরচ মিলিয়ে প্রতিদিন নগদ অর্থে দেয়া হয় ২২৬ টাকার কিছু বেশি। এছাড়া ভর্তুকি মূল্যে রেশন, চিকিৎসা সুবিধা, অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকদের পেনশন, ধান ক্ষেত ও শ্রমিকদের ঘরের ভূমি উন্নয়ন কর, পোষ্যদের শিক্ষা বাবদ ব্যয়, রক্ষণাবেক্ষণ, গরু চড়ানো, চৌকিদার প্রভৃতি বাবদ ব্যয়, ঘর ভাড়া, শ্রমিক কল্যাণ কর্মসুচি ও বাসাবাড়িতে উৎপাদিত ফলমূল বাবদ আয় মিলিয়ে প্রতিদিন দ্রব্য ও সেবায় দেয়া হয় ১৭৬ টাকা ৭৫ পয়সা। সবমিলিয়ে একজন চা শ্রমিককে দৈনিক ৪০২ টাকা ৮৮ পয়সা দেয়ার দাবি করছেন মালিকরা।

তবে চা শ্রমিকরা বলছেন, সুযোগ-সুবিধার অধিকাংশই কাগজে থাকলেও বাস্তবে নেই। মালিকপক্ষ মেডিকেল সার্ভিস দেয়ার দাবি করলেও সেখানে শুধু প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ওষুধ দেয়া হয় না বলে জানালেন বাংলাদেশ চা কন্যা নারী সংগঠনের সভাপতি খায়রুন আক্তার। তিনি বলেন, চা বাগানগুলোর কোনোটিতেই নাই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, এমনকি অ্যাম্বুলেন্স। মালিকরা বলছেন ঘর দেয়া হয়। কিন্তু বাড়িগুলোতে গিয়ে দেখুন, চা শ্রমিকের ঘরের চালায় টিন নেই, দরজা-জানালা নেই। খায়রুন জানালেন রেশনের কথাও। কেজি কেজি চাল-ডাল তো নয়ই বরং দেড় থেকে আড়াই কেজি রেশন দেয়া হয় তাদের।

যদিও স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার দেয়ার কথা বলা আছে, তবে বাগানগুলোতে নেই কোনো শৌচাগার। কাগজে-কলমে শ্রমিকদের বৃষ্টিতে কাজ করার জন্য রেইনকোট দেয়ার কথা থাকলেও এখনও বৃষ্টিতে ভিজে পাতা কুড়াতে হয় শ্রমিকদের। চা বাগানে যথেষ্ট মাতৃত্বকালীন ছুটি নেই বলেও জানালেন চা কন্যা নারী সংগঠনের সভাপতি।

বাংলাদেশীয় চা সংসদ বলছে, গত ১০ বছরে দেশে চায়ের দাম ১৯৭ টাকা থেকে এক টাকাও বাড়েনি। পক্ষান্তরে শ্রমিক মজুরি বেড়েছে ৭৩ দশমিক নয় এক শতাংশ। তারা ১৪ টাকা মজুরি বৃদ্ধি প্রস্তাব করে বলেন, গত মেয়াদের তুলনায় এটি ১১ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি।

বিভিন্ন দফতরে যোগাযোগ করেও কোনো সমাধান পায়নি চা শ্রমিকরা। এ অবস্থায় তাদের স্বার্থ রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চান চান তারা। নতুবা রাজপথে জীবন দেয়া ছাড়া তাদের কোনো পথ নেই, বলে জানালেন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল।

চা শ্রমিক ও মালিক পক্ষের শিল্পবিরোধে প্রতিদিনই বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে চা শিল্প। দ্রুত সংকট সমাধান করে বাগানগুলোতে পূর্ণ্যোদ্যমে উৎপাদন শুরু হবে, এমনটাই চা সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা।

/এডব্লিউ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply