পরিকল্পিতভাবে তিন প্রেমিক হত্যা করেছে স্কুলছাত্রী সানজিদাকে: পুলিশ

|

প্রতীকী ছবি

স্টাফ করেসপনডেন্ট:

পরিকল্পিতভাবে তিন প্রেমিক রংপুরের কাউনিয়ায় দশম শ্রেণির ছাত্রী সানজিদা খানম ইভাকে ছুরিকাঘাতে খুন করেছে বলে দাবি করেছে পুলিশ। এ ঘটনায় দুই প্রেমিককে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে এক প্রেমিক আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তবে ঘটনার আগে সানজিদাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল কিনা তা নিশ্চিত হতে ভ্যাজাইনাল সওয়াব পরীক্ষার জন্য মেডিকেলের ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। ঘটনার ১৮ ঘণ্টার মধ্যেই হত্যার মোটিভ উদ্ধারের দাবিও করেছে পুলিশ।

তবে পরিবার এবং স্কুল শিক্ষকদের দাবি সানজিদা ভদ্র এবং মেধাবী ছাত্রী ছিল। বখাটেদের প্রস্তাবে সাড়া না দেয়াতেই হয়েছে এই খুন।

রংপুর জেলা পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার (সি-সার্কেল) আশরাফুল আলম পলাশ যমুনা টেলিভিশনকে জানান, মঙ্গলবার (১৬ আগস্ট) বেলা আড়াইটায় কোচিং করতে বাড়ি থেকে বের হয়ে প্রেমিকের সাথে বেড়াতে যাওয়ার পর কুটিরপাড়ায় রাস্তায় রাত সাড়ে নয়টায় পড়ে ছিল স্কুল শিক্ষার্থী সানজিদা খানম ইভার রক্তাক্ত শরীর। স্থানীয়দের সহযোগিতায় পুলিশ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় সানজিদার কথিত প্রেমিক নাহিদুল ইসলাম সায়েমকে আমরা গ্রেফতার করি ওই রাতেই। বুধবার রাতে সায়েম আদালতে বিচারকের কাছে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। এ ছাড়াও পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সায়েম অনেক তথ্য জানিয়েছে।

পুলিশ কর্মকর্তা আশরাফুল আরও বলেন, একাধিক প্রেমের কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে কথিত প্রেমিকরা তাকে পরিকল্পিতভাবে খুন করেছে। বিষয়টি ডিজিটাল ডিভাইস চেক, আদালতে দেয়া একজনের জবানবন্দি এবং আমাদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, খুবই স্পর্শকাতর তথ্য আমরা পেয়েছি, যা আমাদের পরিবার এবং সামাজিক মূল্যবোধে সাথে কোনোভাবেই যায় না।

পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও জানান, মঙ্গলবার বেলা আড়াইটায় ভিকটিম বাড়ি থেকে কোচিংয়ে যাওয়ার জন্য বের হলেও বাড়ির ৫০ গজ দুরে বড়দরগার দিকে না গিয়ে নব্দীগঞ্জের দিকে যায়। কিছুদূর গিয়ে তার প্রেমিক পাশের গ্রামের তালুক পশুয়ার নুর হোসেনের পুত্র একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী নাহিদুল ইসলাম সায়েমের মোটরসাইকেল যোগে রংপুর মহানগরীতে যায়। সেখানে শাপলা সিনেমা হলে সিনেমা দেখে। সায়েমের সাথে তার তিন বছরের সম্পর্ক থাকলেও মাস তিনেক আগে বিচ্ছেদ হয়। কিন্তু তাদের মধ্যে কথাবার্তা এবং দেখাশুনাসহ সব কিছুই চলতো। সিনেমা দেখার সময় সায়েমের সাথে সানজিদার অন্য প্রেমিকদের বিষয় নিয়ে কথাকাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে সানজিদা সায়েমের মোবাইল ফোনে তার ফেসবুক আইডি লগ ইন করে। এ সময় সায়েম দেখতে পায় একাধিক ছেলের সাথে সানজিদার আপত্তিকর চ্যাট। তখন সায়েম সানজিদাকে আরেকজন মেয়ের ছবি ও চ্যাটিং দেখিয়ে বলে মেয়েটি সায়েমকে পছন্দ করে। এ সব বিষয় নিয়ে সিনেমা হলেই তাদের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। হল থেকে বাইরে বের হয়ে সানজিদা একাই চলে যায় মাহিগঞ্জে।

পুলিশ কর্মকর্তা আশরাফুল যমুনা টেলিভিশনকে আরও জানান, হলের সামনে থেকে রাগ করে ভিকটিম (সানজিদা) চলে যাওয়ার পর সায়েম সানজিদার আরেক প্রেমিককে মোবাইল করে ঘটনা খুলে বলে। তখন ওই প্রেমিক আরেক প্রেমিকসহ মাহিগঞ্জ আসে এবং তাজহাট কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট সংলগ্ন একটি গলির রাস্তায় সানজিদাকে নিয়ে যায়। একটু পর সেখানে যায় সায়েম। চারজন মিলে সেখানে সিনেমা হলের ঘটনাটি মীমাংসা করে। পরে সেখানে চারজনেই পীরগাছার আলীবাবা থিম পার্কে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে সানজিদা অন্য একজন কথিত প্রেমিকের মোটর সাইকেলে উঠে। আর কথিত আরেকজন প্রেমিক ওঠে সায়েমের মোটরসাইকেলে।

পার্কের সামনে পৌঁছানোর পর রাত হওয়ায় সেখানে ভিতরে যেতে অস্বীকৃতি জানায় সানজিদা। তখন তারা চারজনেই ওই দুটি মোটরসাইকেলে করে সেখান থেকে বাড়ির পথে রওনা দেয়। এর মাঝে একটি ফাঁকা জায়গায় কথা বলার জন্য দাঁড়ালে সেখানে অনেক পথচারী থাকায় আবারও বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয়। পথিমধ্যে টেপামধুপুর-নব্দীগঞ্জ সড়কের হরিচরন লস্কর এলাকায় একটি ফাঁকা জায়গায় দুটি মোটরসাইকেল দাঁড় করায়। এরপর তারা সানজিদাকে তাদেরসহ অন্যান্যদের সাথে সাথে চ্যাট করা, প্রেম করা এবং শারীরিক রিলেশন করার বিষয়ে জানতে চায়। এ নিয়ে তাদের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে প্রথমে সায়েম চাকু বের করে স্টেপ করার চেষ্টা চালায়। তখন হাত দিয়ে বাধা দিতে গেলে উভয়ের হাতের আঙ্গুল কেটে যায়। পরে সায়েম সানজিদার গলায় স্টেপ করে। আরও স্টেপ করতে গেলে চাকু ভেঙে যায়। পরে অন্য দুইজন সানজিদাকে পিছন দিক থেকে পিঠে আঘাত করতে থাকে। সানজিদা মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তারা দ্রুত পালিয়ে যায়। পুরো ঘটনাটি তারা ২ থেকে ৫ মিনিটের মধ্যেই সেরে ফেলে। সেখান থেকে পালিয়ে আসার পর তিনজনই সায়েমের মোবাইলে লগইন করা সানজিদার আইডি থেকে তাদের পক্ষ থেকে চ্যাটিং করা সকল ম্যাসেজ মুছে ফেলে দেয়।

সায়েমকে গ্রেফতারের পর তাদের ডিজিটাল ডিভাইসের পাসওয়ার্ড উদ্ধার করে তাতে খুবই স্পর্শকাতর চ্যাটিং ম্যাসেজ দেখতে পায় পুলিশ। শুধু যে সানজিদারই একাধিক ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিল, তা নয়। ওই তিন ছেলেরই আবার একাধিক মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল।

এ ঘটনায় জড়িত অপর কথিত প্রেমিককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাকে নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করছে জড়িত অন্যজনকে গ্রেফতার করতে।

ঘটনার আগে সানজিদাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল কিনা তা নিশ্চিত হতে ভিকটিমের ভ্যাজাইনাল সওয়াব সংগ্রহ করে তা পরীক্ষার জন্য মেডিক্যালে পাঠানো হয়েছে।

সানজিদার বাবা ইবরাহিম খান জানান, আমার মেয়ে কেমন ছিল এই সড়ক দিয়ে যাতায়াতকারী সকল অটো ওয়ালা এবং এলাকাবাসী জানেন। আমার মেয়ে যদি খারাপ হয়, তাহলে আমি বিচার চাই না। যদি ভালো হয় তাহলে আমি তাদের ফাঁসি চাই।

তিনি আরও বলেন, এটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তা না হলে ঘটনাস্থলে দুটি ছুরি পাওয়া গেলো কেন। আমার মেয়েকে যদি ভালোবাসতো তাহলে এভাবে কেউ খুন করতে পারে না। হয়তো তারা যেটা চাইতো, তাতে আমার মেয়ে রাজি ছিল না। সেকারণেই তারা ক্ষুব্ধ হয়ে আমার মেয়েকে মেরেছে।

সানজিদা স্থানীয় বড়দরগা উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। তার পিতা ইবরাহিম খান মাস সাতেক আগে সৌদি আরব থেকে ফিরে মাহিগঞ্জে ইলেক্ট্রনিক্সের ব্যবসা করতেন।

/এনএএস


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply