কেজিএফ: এক স্বপ্ন-শহরের উত্থানের ইতিহাস

|

ছবি: সংগৃহীত

সোনার জমি! এমন জায়গা যেখানে ‘সোনা’ ফলে। সোনার ফসল নয়, আসল সোনা। চোখ ধাঁধানো সোনালি রঙের কম ক্ষয়বিশিষ্ট বিরল ধাতু। বছর বিশেক আগেও কেজিএফ বা কোলার গোল্ড ফিল্ড ছিল সেই সোনার আঁতুড়ঘর।

কন্নড় ভাষার বক্স অফিসে ঝড় তোলা ছবির দৌলতে এখন কেজিএফ পরিচিত নাম। অথচ ২০০১ সালের পর গত ২১ বছর কেজিএফের কথা মনেই রাখেনি কেউ। যারা কেজিএফকে এখন দেখছেন তারা শহরটির নাম দিয়েছেন ‘ভূতুরে শহর’।

কন্নড় সিনেমা কেজিএফেও বহুবার এলাকাটিকে ‘নরক’ বলে উল্লেখ করতে দেখা গিয়েছে। অথচ এই কেজিএফ নিয়েই এককালে গর্বের অন্ত ছিল না ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের। কেজিএফকে দেখিয়ে বিশ্ব ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু।

কর্নাটকের কোলার গোল্ড ফিল্ড ওরফে কেজিএফে এক সময়ে ছিল কোলার নামের একটি গ্রাম। মাটির নীচে তো বটেই, সবাই জানতেন এবং মানতেন যে এ গ্রামের ধুলাতেও সোনা মিশে থাকে। এই বিশ্বাস থেকেই সম্ভবত চোল-চালুক্যদের রাজত্বের সময় থেকে কোলারকে সব সময় দখলে রেখে এসেছে শাসকেরা। এক একটি শাসনকাল ৮০০ থেকে এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে চলেছে। শাসকের নীতির জোরে কখনও বিস্তৃত কখনও কমে এসেছে রাজ্যপাট। তবু কোলার হাতছাড়া হতে দেয়নি কেউ। তবে কোলারের দখল নিলেও সেই সময়ে চোল, চালুক্য রাজারা সোনা খনন করাতেন কিনা তা জানা যায় না। ভারতের সরকারি নথি অনুযায়ী সেই কাজ শুরু হয়েছিল ১৮৭৫ সালেই।

মাইকেল ফিৎজগেরাল্ড লাভেল নামে এক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ সৈনিক প্রথম কোলারের মাটির নীচ থেকে সোনা তোলার কাজ শুরু করেন। কোলারের সোনার ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ সমৃদ্ধ একটি বই লিখেছিলেন ব্রিটেনের এক ইতিহাসবিদ। সেই বই লাভেলের হাতে আসে।

কোলারের পুরানো ইতিহাস জেনে তিনি ঠিক করেন, কোলারের মাটির নীচে সোনা সত্যিই আছে কিনা তার খোঁজ শুরু করবেন। প্রাথমিকভাবে সফলও হন লাভেল। তবে খনি থেকে সোনা তোলার কাজে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন ছিল। মাইকেলের সেই সামর্থ্য ছিল না। তিনি জন টেলর অ্যান্ড সনস নামে ব্রিটেনেরই একটি সংস্থাকে বিক্রি করে দেন কোলারের সোনার খনি।

১৮৮০ সালে ওই ব্রিটিশ সংস্থার হাত ধরে শুরু হয় কেজিএফের শ্রীবৃদ্ধি। তখন বেঙ্গালুরু কর্নাটকের রাজধানী। কিন্তু সেখান থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে হঠাৎ শহর হয়ে ওঠা একটি গ্রামই হয়ে উঠতে থাকে দক্ষিণের রাজ্যটির প্রাণকেন্দ্র। একে কর্নাটকের মনোরম আবহাওয়া। তার ওপর আধুনিক সুযোগ সুবিধার অন্ত ছিল না কোলারে। সেখানকার বাসিন্দা ব্রিটিশ কর্মচারীরা ‘মিনি ইংল্যান্ড’ বলে ডাকতে শুরু করেছিল কোলারকে।

কোলার ছিল ভারতের প্রথম শহর যেখানে বিদ্যুৎ সংযোগ এসেছিল। শুধু ভারতে নয়, জাপানের টোকিওর পর কোলারই ছিল এশিয়ার দ্বিতীয় শহর যেখানে বিদ্যুতের সুবিধা ছিল। খনির কাজের জন্য কাছেই কাবেরি নদীর ঝরনায় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করেছিল ব্রিটিশ সরকার। পাশাপাশি খনিতে পানি সরবরাহ করার জন্য কোলারে একটি বিশাল হ্রদও খুঁড়া হয়েছিল।

কী ছিল না কেজিএফে! ছিল নিজস্ব গল্ফ খেলার মাঠ, হাসপাতাল, ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল-কলেজ, ছেলে এবং মেয়েদের কনভেন্ট স্কুল, ক্লাব, মনোরঞ্জনের নানা ব্যবস্থা। এমনকি কেজিএফে বসবাসকারী ব্রিটিশ এবং ভারতীয় কর্মকর্তাদের জন্য ব্রিটেনের স্থাপত্যের বড় বড় বাংলোও তৈরি হয়েছিল। যদিও কোলারের এই ‘মিনি ইংল্যান্ডে’ প্রবেশাধিকার ছিল না খনিতে কাজ করা শ্রমিকদের। তারা থাকতেন কোলারের ঝকঝকে আলোর বাইরে। ছোট ছোট খুপরির মতো ঘরে। সেই সব এলাকাকে বলা হতো কুলি লেন। ঘরগুলিকে বলা হতে শান্টি। সেখানে কষ্ট করেই থাকতেন খনি শ্রমিকরা। তবু বেঙ্গালুরুসহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ আসতেন কোলারে কাজ করতে।

১৯০২ সাল পর্যন্ত ভারতের মোট সোনা উৎপাদনের ৯৫ শতাংশই আসতো কোলার থেকে। এই শতকের গোড়া পর্যন্তও সোনা উত্তোলন হতো কেজিএফ থেকে। শেষ বার কেজিএফ থেকে সোনা উত্তোলন হয় ২০০১ সালে। তবে গত শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে।
তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা
ইউএইচ/


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply