দরিদ্র ও সুন্দরী স্কুলছাত্রীদের বাছাই করে করে ধর্ষণ করতো শিক্ষক

|

প্রদ্যুৎ কুমার সরকার, মাদারীপুর:

ক্লাস সেভেনে উঠতেই নিজের ছাত্রীদেরকে টার্গেট করতো রবিউল। সুন্দরী ও দরিদ্র ছাত্রী- এটা ছিল তার বাছাইয়ের ক্যাটাগরি। পড়ালেখায় সহযোগিতা করার নামে তাদেরকে বাসায় নিয়ে যেত অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের সাথে। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল নয় এমন মেয়েদের জন্য বাসায় খাবারেরও ব্যবস্থা করতো রবিউল। একটু মন জয় করার পরই সুযোগ বুঝে একা বাসায় ডাকতো ছাত্রীদের। প্রথমে ধর্ষণ এবং সেসব দৃশ্য ভিডিওতে ধারণ। এরপর মাসের পর মাস ধরে কিশোরী মেয়েদের উপর চলতো রবিউলের নির্যাতন। ভিডিও প্রকাশ হয়ে পড়ার ভয়ে দরিদ্র ঘরের অল্প বয়সী মেয়েরা তাদের শিক্ষক রবিউলের মর্জি মতো চলতে বাধ্য হতো।

মাদারীপুরের শিবচরের উমেদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে গত কয়েক বছর ধরে চলছিলো এক শিক্ষকের এমন ধর্ষণযজ্ঞ। সম্প্রতি নির্যাতিত এক ছাত্রী মুখ খোলার পর হাওয়া হয়ে গেছে এই সিরিয়াল ধর্ষক। রবিউলের অপকর্ম জানাজানি হওয়ার পর দেড়মাস পার হলেও স্কুল কর্তৃপক্ষ, আইনশৃংখলা বাহিনী কেউই যেন তার নাগাল পাচ্ছে না!

 

সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, রবিউল ইসলাম উমেদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। ৫ম ও ৮ম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তিপ্রাপ্ত একই বিদ্যালয়ের এক দরিদ্র মেধাবী সুন্দরী ছাত্রীর প্রতি সে ৭ম শ্রেণি থেকে বিশেষ খেয়াল রাখতো। শিক্ষকের কাছ থেকে সহযোগিতা পাওয়ায় ওই ছাত্রী সহজেই রবিউলের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। ক্লাসের এক নম্বর রোল ধারী ছাত্রীটিকে আরও ৪/৫ জন শিক্ষার্থীর সাথে রবিউল তার বাসায় নিয়ে খাওয়াতো ও পড়াতো।

এক সন্তানের জনক রবিউলের স্ত্রী অন্য উপজেলায় চাকরি করার সুবাদে বাসায় নির্বিঘ্নেই ছাত্রীরা যাতায়াত করতো। ৮ম শ্রেণিতে ওঠার পর একদিন রবিউল মেয়েটিকে বাসায় একা নিয়ে ধর্ষণ করে। সেই দৃশ্য ভিডিওতে ধারণ করে রাখে। এরপর থেকেই সুযোগ বুঝে ছাত্রীটিকে তার বাসায় ডাকতো। কিশোরী মেয়েটি রাজি না হলে আগের ভিডিও প্রকাশ করে দেয়ার ভয় দেখাতো। পাশাপাশি বিয়ের প্রলোভনও দিত। এভাবেই অসহায় মেয়েটির সাথে নিয়মিত শারীরিক সম্পর্ক গড়ে শুরু করে রবিউল।

ভুক্তভোগী মেয়েটির অভিযোগ, এর মধ্যে একাধিকবার গর্ভপাতের ঘটনাও ঘটানো হয়। কয়েক মাস তার সাথে এভাবে চলার পর অন্য ছাত্রীদের বাসায় আনা দেখে আপত্তি করে মেয়েটি। এক পর্যায়ে সে জানতে পারে স্কুলের আরো কয়েকজন ছাত্রীকে রবিউল একই কায়দায় সম্পর্কে জড়াতে বাধ্য করেছে।

এসব জেনে ছাত্রীটি সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাইলে তাকে আবারও ভয়-ভীতি দেখায় রবিউল। এভাবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় দুই বছর ধরে রবিউল ওই ছাত্রীর সাথে জোরপূর্বক শারিরীক সম্পর্ক অব্যাহত রাখে। বর্তমানে সে দশম শ্রেণিতে অধ্যায়নরত।

সম্প্রতি রবিউল স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের মাঝে মেয়েটির নামে কুৎসা ছড়ায়। তখন বাধ্য হয়ে রবিউলের বিচার চেয়ে গত ১৩ মার্চ স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটি বরাবর লিখিত অভিযোগ দায়ের করে ভুক্তভোগী ছাত্রী। এরপরই বের হয়ে আসতে থাকে রবিউলের আরও অপকর্মর তথ্য। একাধিক মেয়ের সাথে আপত্তিকর ছবি, অডিও রেকর্ড পাওয়া যায় তার কাছে। পাওয়া গেছে ভুক্তভোগী মেয়ের সাথে ‘বরের বেশে’ তোলা ছবিও। স্কুলের একটি অনুষ্ঠানে মেয়েটিকে শাড়ি পরে আসতে বলে রবিউল। অনুষ্ঠানস্থলেই পাঞ্জাবির সাথে পাগড়ি পরে ছবি তুলে ওই ছাত্রীর সাথে।

বর্তমানে ৯ম ও দশম শ্রেণিতে পড়ছে এমন দুই ছাত্রীর পরিবারের পক্ষ থেকেও নাম প্রকাশ না করার শর্তে রবিউলের বিরুদ্ধে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ করা হয়েছে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে প্রধান শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির সদস্যদের কাছে স্বীকারোক্তিও দিয়েছে রবিউল। পরিস্থিতি প্রতিকূলে চলে যাচ্ছে দেখে ছুটি না নিয়েই বর্তমানে পালিয়ে আছে এই সিরিয়াল ধর্ষক। অজ্ঞাতস্থান থেকে ফোন করে ওই ছাত্রীকে অভিযোগ তুলে নেয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছে।

অভিযোগে উঠেছে, স্কুল রবিউলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া থেকে বিরত থাকছে।

দুই বছর ধরে নির্যাতনের শিকার হওয়া ছাত্রীর অভিভাবক বলেন, ‘রবিউল শিক্ষক নামের কলংক। আমাদের সদা হাসি-খুশি মেয়েটির জীবন নষ্ট করে দিয়েছে। আমরা ওর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’

ওই ছাত্রী বলেন, ‘রবিউল স্যার আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে প্রথমে লেখাপড়ার খোজ-খবর নিত। পরে অন্য কয়েকজনের সাথে আমাকেও বাসায় নিয়ে পড়াতো। আমার মতো আরও কয়েকজন সিনিয়র আপাকেও সে একই কায়দায় ফাঁসিয়েছে।’

ভুক্তভোগী মেয়েটি বলেন, ‘স্কুলের সুন্দরী মেয়েদের সে ৭ম বা ৮ম শ্রেণি থেকেই টার্গেট করে বিভিন্নভাবে ফুসলিয়ে এই জঘন্য কাজ করে আসছিলো। ওর বিচার চাই, যাতে আর কারো ক্ষতি করতে না পারে।’

উমেদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রোকনুজ্জামান বলেন, অভিযোগ পাওয়ার পর এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদে রবিউল ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছে। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই পালিয়ে গিয়ে এখন ফোনে ওই ছাত্রীকে হুমকি দিচ্ছে। আমরা শিক্ষকরা পরিচালনা পরিষদের সদস্যদের সাথে আলোচনা করেছি। তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যাবস্থা নেয়া হচ্ছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্য এক ছাত্রীর মা বলেন, ‘রবিউল আমার মেয়ের সাথেও শারিরীক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। আমরা জানতে পেরে মেয়েকে ফিরিয়ে আনলেও সে ভয় দেখাতো। পরে হেড স্যারকে বিষয়টি জানিয়েছিলাম। ওর মত শিক্ষকের কঠিন বিচার হওয়া উচিত।’

বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পারভীন বেগম বলেন, ‘ওই ছাত্রীর সাথে শারিরিক সম্পর্কের বিষয়টি আমরা যখন জানতে পারি তখন রবিউলকে জিজ্ঞাসা করলে আমাদের কাছে সে বিষয়টি স্বীকার করেছে। এ ঘটনায় আমরা শিক্ষকরা অনেক লজ্জায় পড়ে গেছি। রাস্তায় চলাফেরায় অনেক বিব্রতবোধ করছি। এটার সঠিক বিচার হওয়া উচিত।’

স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি কাদির খালাসী বলেন, আমরা অভিযোগের সত্যতা পেয়েছি। দ্রুতই অভিযুক্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেয়া হবে।

এ ব্যাপারে রবিউলের সাথে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

মাদারীপুরের সহকারী পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন বলেন, এ ব্যাপারে ছাত্রীর পক্ষ থেকে অভিযোগ করলে কঠোর ব্যবস্থা নেবো।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply