রোহিঙ্গাদেরকে ব্যক্তি উদ্যোগে ত্রাণ দেয়া যাবে, তবে…

|

কুতুপালং থেকে কদরুদ্দীন শিশির

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এক ট্রাক প্লাস্টিকের ঘরোয়া আসবাবপত্র পাঠানো হয়েছে রোহিঙ্গাদের জন্য। বালতি, গ্লাস, জগ, মগ, প্লেট ইত্যাদি। অ্যালোমুনিয়ামের কলস, হাড়িও রয়েছে। কুতুপালং বাজারে অস্থায়ী শরণার্থী শিবিরের সামনে দাঁড় করানো হয় ট্রাকটি। ৫ মিনিটেরও কম সময়ে গাড়ির চারদিকে কয়েকশ’ মানুষ এসে দাঁড়িয়ে যান। বেশিরভাগই পুরুষ। কিছু মহিলা ও শিশুও দাঁড়িয়েছিল। বিতরণকারীরা কিভাবে বন্টন করবেন তা নিয়ে কথাবার্তা বলছিলেন। কিন্তু তারা সিদ্ধান্ত নেয়ার আগেই গাড়িতে হাত লাগানো শুরু হয়ে যায়। সাথে সাথে হৈ হল্লোড়। অন্যরাও হাত লাগিয়ে যে যার মতো নিয়ে যাবে দেখে দ্রুত ট্রাকের পেছনে উঠেন বিতরণকারীরা। একেকজনকে একেক জিনিস দিচ্ছিলেন। এরপর শুরু হল যুদ্ধ! কে কার আগে পাবে। ১০ মিনিটের পাড়াপাড়ি, ধাক্কাধাক্কি শেষে কিছু পুরুষই শুধু সফল হলেন। তারা নিজেরা হাত লাগিয়ে কয়েকটা করে পণ্য বাগিয়ে নিয়ে ভাগলেন। শিশুরা তো কাবু করার প্রশ্নই উঠে না, নারীরাও থাকলেন নিরাপদ দূরত্বে। ধাক্কাধাক্কিতে ভেঙে গেছে পাশের বাড়ির বাঁশের উঁচু বেড়া। সেটির নিচে পড়ে অল্প আহত হয়েছেন কয়েকজন।

জোর করে ত্রাণ নেয়া এইসব পুরুষ মানুষরা কারা? এবার তো রোহিঙ্গাদের স্রোতে পুরুষরা আনুপাতিক সংখ্যায় এত ছিল না। ট্রাক থেকে ত্রাণ বিতরণের ঘটনা যারা দেখছিলেন এমন কয়েকজন স্থানীয় দোকানদার জানালেন, হাত লাগিয়ে ইচ্ছা মতো নিয়ে যাওয়া এবং বিশৃংখলা তৈরিকারীর বেশিরভাগই পুরোনো রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা। আর কিছু আছেন স্থানীয় মানুষ!

কোনো কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে যে যার ইচ্ছা মতো ত্রাণ বিতরণ এভাবে বহু সমস্যা তৈরি করছে কুতুপালং, বালুখালী ও উনছিপ্রংয়ের রাস্তাগুলোয়।

অনেকে বাস দিয়ে যাওয়ার সময় ছুঁড়ে মারছেন টাকা বা কোনো খাবারের পুটলা। সেটা সংগ্রহ করতে গিয়ে দৌড়াদৌড়ি-ধাক্কাধাক্কি লেগে আহত হচ্ছেন অনেকে। মারামারি লেগে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। কেউ কেউ গাড়ি বা রিকশার সাথে ধাক্কা খেয়ে হাসপাতালেও গিয়েছেন।

কেউ ছোট গাড়িতে করে বা হাতে করে খাদ্য সামগ্রী নিয়ে নিজের সুবিধা মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে কিছু লোকের মধ্যে বিতরণ শুরু করলেন। এতে অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির সৃষ্টি তো আছেই, তার চেয়ে বড় সমস্যা হল- এভাবে সবাই ত্রাণ দিলে কেউ পাঁচবার পাচ্ছে, আর কেউ একবারও পাচ্ছে না।

রাস্তায় ত্রাণ পাওয়ার আশায় শরণার্থীদের বড় অংশ নিজেদের জন্য বরাদ্দ নির্দিষ্ট তাবুতে বসে না থেকে রাস্তায় ভিড় জমাচ্ছে। এতে চলাচলে যেমন সমস্যা হচ্ছে, তেমনি শিশুরা গাড়ির ধাক্কা খাচ্ছে, আহত হচ্ছে। এমএসএফ চিকিৎসা ক্যাম্পের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রতিদিন তাদের এখানে এরকম আহত ২০/২৫ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

বয়স্ক লোক এবং একাধিক বাচ্চা কোলে থাকা নারীরা এভাবে দৌড়াদৌড়ি করে, ভিড় ঠেলে ত্রাণ নিতে পারছেন না। এছাড়া যারা আরাকানে সামাজিকভাবে একটু উপরের কাতারের ছিলেন, তারা রাস্তায় আসছেন না ত্রাণ নিতে। কিন্তু তাদের কাছেও খাবার কেনার মতো কোনো টাকা নেই। কেউ তাদের তাবুগুলোতে খাবার নিয়ে গেলে সেখান থেকে কিছুটা পাচ্ছেন। অন্যথায় এই ধরনের পরিবারগুলোকে নীরবে ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে। কুতুপালং নতুন ক্যাম্পের এযযু রহমান, রহমতুল্লাহ দলু, নুর আলমরা নিজেদের এমন অবস্থার কথা তুলে ধরেছেন।

গত কয়েকদিন ধরে কেন্দ্রীয়ভাবে ত্রাণ বিতরণ নিয়ন্ত্রণ করার কোনো উদ্যোগ সরকারিভাবে ছিল না। তবে রোববার থেকে কুতুপালং পেট্রোল পাম্পের সামনে নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র বসিয়েছে জেলা প্রশাসন। এর মাধ্যমে পুরো বিতরণ প্রক্রিয়াকে একটি পদ্ধতির মধ্যে নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন দায়িত্বরত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জুয়েল আহমেদ।

তিনি জানান, যে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন ত্রাণ নিয়ে আসতে পারবেন। বিতরণের আগে আমাদের এখানে নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে রিপোর্ট করে তালিকাভুক্ত হতে হবে। কোথায় খাবারের বা অন্যান্য ত্রাণের প্রয়োজন আছে সে খবর আমরা সংগ্রহ করছি। ছড়িয়ে থাকা রোহিঙ্গাদেরকে বিভিন্ন স্থানে একত্রিত করার উদ্যোগ নিয়েছি। যে এলাকায় খাবার লাগবে আমরা ত্রাণ নিয়ে আসা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে জানিয়ে দেব। তারা সেখানে গিয়ে নিজ হাতে বন্টন করে আসবেন।

জুয়েল আহমেদ আরও জানান, ত্রাণের পরিমাণ বেশি হলে ওই নির্দিষ্ট স্থানে শৃংখলার জন্য আনসার বা অন্য নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদেরকেও সাথে দেয়া হবে।

দুয়েকটি সংবাদমাধ্যমের বরাতে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে ব্যক্তি উদ্যোগে ত্রাণ দেয়া যাবে না, সরকারের মাধ্যমে দিতে হবে। এ বিষয়ে জুয়েল বলেন, কোনো রাজনীতি বা ধর্মীয় উস্কানির সুযোগ যাতে কেউ না পায় আমরা শুধু সেটা দেখবো। কিন্তু ব্যক্তি উদ্যোগে ত্রাণ দেয়ায় কোনো বাধা নেই। আমরা শুধু বিষয়টাকে শৃংখলার মধ্যে আনার চেষ্টা করছি।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply