‘নির্বাচন এখন আইসিইউতে ও গণতন্ত্র লাইফ সাপোর্টে’

|

নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। ফাইল ছবি

প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অসহিষ্ণু মনোভাব দেশে গণতন্ত্রকে অন্তিম অবস্থায় নিয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। তার ভাষায় নির্বাচন এখন ‘আইসিইউতে’ ও গণতন্ত্র ‘লাইফ সাপোর্টে’। আর এ সংকটের অবসান ঘটতে পারে সব দলের সমঝোতার মাধ্যমে।

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সহিংতার প্রেক্ষাপটে রোববার (১৪ নভেম্বর) বিকেলে নিজের প্রতিক্রিয়া জানাতে সাংবাদিকদের সামনে সামনে হাজির হন এই নির্বাচন কমিশনার। সহকর্মীদের সাথে ভিন্নমত পোষণ করে আলোচিত মাহবুব তালুকদার বরাবরের মতোই লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান, যার শিরোনাম তিনি দেন, ‘দ্বিতীয় ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ও অন্যান্য প্রসঙ্গ নিয়ে আমার কথা’।

মাহবুব তালুকদার বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ যতই ফুরিয়ে আসছে, নির্বাচন ব্যবস্থা ও অবস্থা দেখে ততই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছি। আজও রূপকার্থে কিছু কথা বলতে চাই। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচন এখন আইসিইউতে। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে গণতন্ত্র এখন ‘লাইফ সাপোর্টে।

নিজের কথার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, দেশে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অসহিষ্ণু মনোভাব গণতন্ত্রকে অন্তিম অবস্থায় নিয়ে গেছে। খেলায় যেমন পক্ষ-বিপক্ষের প্রয়োজন হয়, তেমনি একপক্ষীয় কোনো গণতন্ত্র হয় না। বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে কোনো মূল্যে গণতন্ত্রকে আমরা লাইফসাপোর্ট থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চাই। এজন্য দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা প্রয়োজন। আমি আবারও পুনরাবৃত্তি করে বলতে চাই, এই সঙ্কট নিরসনে সকল দলের সমঝোতা অপরিহার্য।

ইসি নিয়োগে দ্রুত আইন করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সংবিধানের বাধ্যবাধকতা সত্ত্বেও সুদীর্ঘ ৫০ বছরে নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন প্রণয়ন করা হয়নি। নির্বাচন প্রক্রিয়া সংস্কারের জন্য এই আইন প্রণয়ন অবধারিত হলেও তা যথেষ্ট নয়। এতে নিরপেক্ষভাবে সব রাজনৈতিক দলের স্বার্থ সংরক্ষণ করা আবশ্যক এবং তা সকল দলের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া বাঞ্ছনীয়।

সবার মতামত নিয়ে আইন না হলে তার পরিণতিও খারাপ হবে বলে সতর্ক করে মাহবুব তালুকদার বলেন, একপক্ষীয় আইন করে কোনো লাভ হবে না। একপক্ষীয় আইন কেবল একদলীয় শাসনের পথ উন্মুক্ত করে। বিষয়টির যত তাড়াতাড়ি ফয়সালা হয় ততই মঙ্গল। নইলে দেশব্যাপী নৈরাজ্যের আশঙ্কা আছে।

এদিকে মাহবুব তালুকদার নিজের মত প্রকাশের পর নির্বাচন কমিশনের জনসংযোগ পরিচালক এস এম আসাদুজ্জামান জানিয়েছেন, সোমবার (১৫ নভেম্বর) সংবাদ সম্মেলন করবে ইসি। এতে সিইসি কে এম নূরুল হুদাসহ অন্য নির্বাচন কমিশনাররা থাকবেন।

মুখর সহকর্মীকে নিয়ে ইতোমধ্যে সিইসি নূরুল হুদা বলেছেন, ইসিকে হেয় করতে সবই করছেন মাহবুব তালুকদার।

এবছর দুই ধাপে প্রায় ১২শ’ ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন শেষ হয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে আরও দুই সহস্রাধিক ইউনিয়নে ভোট রয়েছে। ইতোমধ্যে নির্বাচন-পূর্ব ও নির্বাচনের দিন এবং নির্বাচনোত্তর সহিংসতায় অনেক প্রাণহানি ঘটেছে।

ইউপিতে দলীয় প্রতীক বাদ দেয়ার সুপারিশ করে মাহবুব তালুকদার বলেন, এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে রক্তাক্ত নির্বাচন বললে অত্যুক্তি হবে না। নির্বাচনের সময় ও তার আগে পরে এ পর্যন্ত ৩৯ জন নিহত হয়েছেন। জীবনের চেয়ে নির্বাচন বড় নয়, এই বার্তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কাছে পৌঁছাতে সম্ভবত ব্যর্থ হয়েছি।

ইউপিতে দ্বিতীয় ধাপে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৮০ জনের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার দিকটি দেখিয়ে তিনি বলেন, একে আক্ষরিক অর্থে নির্বাচন বলা যায় না। যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই, সেখানে নির্বাচন নেই। বিশ্বে আদর্শ নির্বাচনের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে কুমিল্লার লাকসাম উপজেলা ও চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলা।

কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যানের সাথে সাধারণ সদস্য ও সংরক্ষিত সদস্য পদে ৬৫ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। অন্যদিকে রাউজান উপজেলায় ১৪ ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান, ১২৬ জন সদস্য ও ৪২ জন সংরক্ষিত আসনের সদস্য সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত।

স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচন দলীয় প্রতীক ছাড়া করার আগের বিধান ফিরিয়ে আনার পক্ষে মত দেন মাহবুব তালুকদার। তিনি বলেন, ইউপি নির্বাচন দলীয় ভিত্তিতে না হয়ে পূর্বের ন্যায় সবার জন্য উন্মুক্ত হলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ থাকবে না। যে নির্বাচন প্রক্রিয়া নির্বাচন কমিশন ঠিক করে না, তার দায় কমিশন কেন নেবে? আমার মতে পৃথক একটি স্থানীয় নির্বাচন কর্তৃপক্ষ গঠন করে এসব নির্বাচন করা যায়। তবে এই পরিবর্তন রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ব্যাপার।

নির্বাচন আয়োজনকারী সাংবিধানিক সংস্থা ও সচিবালয়ের কর্তৃত্ব নিয়ে আগেও ক্ষোভ দেখিয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। একক প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার প্রসঙ্গ ধরে তিনি বলেন, সারাদেশে যদি সন্ত্রাসমুক্ত এ ধরণের নির্বাচন করা যায়, তাহলে নির্বাচন কমিশনের বদলে একজন সচিবের অধীনে একটি সচিবালয় থাকলেই যথেষ্ট!

জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনের বড় সমস্যা হলো রিটার্নিং কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন না অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, রিটার্নিং অফিসারগণকে রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের কিংবা স্থানীয় নেতাদের প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত মনোভাব অনুধাবন করে চলতে হয়। ফলে তারা হানাহানি, গোলযোগ ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো ধামাচাপা দিতে চান। তাদের ধামাধরা না হয়ে উপায় থাকে না।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply