‘হে সাকিব-মুশফিকেরা, তোমরা আমার আয়ু কমিয়ে দিয়েছো!’

|

অফিস টাইম বিকেল ৬টায় শেষ। সারাদিন বাংলাদেশ-ভারত ফাইনাল নিয়ে বিভিন্ন ধরণের নিউজ করেছি। অফিস শেষ হলেও বাসায় আর যেতে ইচ্ছে করলো না। ভাবলাম, এমন ইভেন্ট বাসায় বসে মিস করা ঠিক হবে না। শেষ পর্যন্ত অফিসেই থেকে যাই। খেলা শুরু হলে যমুনা টেলিভিশনের ফেসবুক পেইজে ওভারে ওভারে আপডেট দেয়ার দায়িত্বটা নিজের ঘাড়েই নেই। পুরো খেলাটা আমি বলে বলে দেখেছি। আর পাঠকদের জানিয়েছি। একবার টিভির সামনে দৌড়ে যাই, আবার কম্পিউটারের সামনে বসে আপডেট করি। যত তাড়াতাড়ি দেয়া যায়, এটাই ছিলো তাড়না। জানি সবাই টিভির সামনে বসে খেলা দেখছে, তবুও মনে হয়েছে কেউ যদি জানার অপেক্ষায় থাকে। তাই যত তাড়াতাড়ি আপডেট দেয়া যায় সেটাই করছিলাম।

বাংলাদেশের ছেলেরা চার-ছয় মারে, আর আমরা চিৎকার করি, লাফিয়ে উঠি, আবার তথ্য আপডেট করি। একদিকে নিজের ভালোলাগা, আবেগ। আবার অন্যদের জানানোর দায়িত্ববোধ। সবমিলে প্রতিটি মুহূর্ত উত্তেজনাকর।

বাংলাদেশের এক একটি উইকেট পড়ে আর স্নায়ুর ওপর চাপ বাড়তে থাকে। ভেতরে ভেতরে পুড়তে থাকি। যখন ৪র্থ ওভারে ১১ রানে লিটন দাস আউট হয়ে যায় তখন স্বপ্ন দেখি তামিমকে নিয়ে। যখন পরের ওভারে সৌম্য ১ রানে আর তামিম ১৫ রানে আউট হয়ে যায় তখন স্বপ্নে হালকা চিড় ধরে। কারণ তখন দলীয় রান মাত্র ২৭। তবুও মুশফিক ও মাহমুদুল্লাহকে নিয়ে আশায় বুক বেঁধে এগিয়ে যাই। ১২ ওভারে যখন চার উইকেটে ৮২ তখন ভয় পাচ্ছিলাম ভারতের ব্যাটিং লাইনকে। আমাদের আরও আরও রান করতে হবে। যখন ভুল বোঝাবুঝিতে মাহমুদুল্লাহ রান আউট হয়ে যায়, বিরক্ত হই। যখন সাকিবও রান আউট হয় তখন আল্লাহকে ডাকা ছাড়া আর কোন উপায় দেখি না।

শেষ পর্যন্ত সাব্বিরের ৭৭ রানের ইনিংসে বাংলাদেশ ১৬৭ রানের টার্গেট দেয় ভারতকে। আমি আশায় থাকি। কারণ এটাও অনেক রান। এতোসব মনের ভেতর চললেও আমার কাজ চলতেই আছে। মাথায় এক ধরণের অনুভূতি আর হাতে চলে পাঠককে জানানোর কাজ। কত ওভারে কত রান, কখন কে আউট হলো জানিয়ে যাচ্ছি। আমি খেলার প্রতিটি বলে বলে ডুবে আছি।

বাংলাদেশের ব্যাটিং শেষ হলে। খেলা আবার শুরু হয়, আমরা সবাই নানা স্টোরির প্লান করতে থাকি। জিতলে কী কী ধরণের নিউজ করবো। সে অনুযায়ী চলছে প্রস্তুতি। পুরো নিউজরুমের মাঝেই এক ধরণের উত্তেজনা দেখা দিচ্ছে।

পাঠক হয়তো টিভিতে খেলা দেখছে তবুও বাংলাদেশ জিতে গেলে যেনো বিভিন্ন আঙ্গিকের খবর তাদেরতে দেয়া যায়- তারই প্রস্তুতি সবার মাঝে। কোনভাবেই পাঠককে কোন খবর মিস করানো যাবে না।

ভারতের ইনিংসের শুরুতেই যখন রোহিত শর্মা ‘পেটানো’ শুরু করে ভয়ে কুঁকড়ে যাই! সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি, রোহিত যেন আউট হয়ে যায়।

প্রথমে ধাওয়ান আউট হতেই এক চিৎকার। নিউজ রুমে হইহই অবস্থা। আমি উৎসব করবো নাকি আপডেট দিবো এ নিয়ে পড়ি বিপাকে। তখন দ্রুত আপডেট দেয়াটাই আমার উৎসব উদযাপন হয়ে উঠে। একটু পরে যখন ০ রানে রায়না আউট হয়ে যায় তখন সে-কী লাফালাফি। চিৎকার। সবাই জয়ের স্বপ্ন নিয়ে জলমলে হয়ে উঠে। অফিসে উৎসবের রঙ ছড়িয়ে পড়ে।

রোহিতকে ‘থামাতে হবে’ তখন এটাই আমাদের চাওয়া। এই চাইতে না চাইতে রুবেলের বলে রাহুল দলীয় ৮৩ রানে প্যাভিলিয়নে গেলে আনন্দ ধরে রাখতে পারি না। সাথে সাথে খাওয়ার ঘোষণা। লুচি আর চিকেন চাপ আনার জন্য দৌড়ে যায় একজন। কিভাবে পার্টি হবে মাথায় চলে তার পরিকল্পনা। হাতে চলে আপডেট দেয়া। সে-কী দ্বিমুখী পদচারণা!

১৪ ওভারে যখন রোহিত শর্মা আউট হয়ে যায় বাঁধভাঙা মাতামাতি। কেউ এসে জড়িয়ে ধরে। কেউ চিৎকার করে। কেউ ছবি কাটতে প্যানেলে দৌড়ায়। কেউ নিউজ লিখতে শুরু করে। এক মহাযজ্ঞের আয়োজন শুরু হয়। হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। নিউজ তৈরি করতে হবে। সবাই নেমে পড়েছে কাজে। পাঠক ভাবতেই পারবে না একজন সাংবাদিককে নিজের আবেগকে দমিয়ে রেখে কিভাবে তাদের জন্য সংবাদ প্রস্তুত করতে হয়। ইচ্ছে হয় উৎসবে মেতে উঠি। কিন্তু সেটা করলে আর নিউজ দেয়া হয়ে উঠবে না। যাইহোক, ভারতকে জিততে হলে দরকার ৩৬ বলে ৬৩ রান। মাঠে হয়তো সাকিবরা খেলে কিন্তু আমরা এই বাংলাদেশে বসে মাঠে খেলার থেকে মানসিক চাপের মধ্যে থাকি।

১৮তম ওভারে যখন ৪টা ডট বল দেয় মোস্তাফিজ। প্রতিটি ডট বলের সাথে আমাদের গলাফাটা চিৎকার। কে কী করছে বোঝা বড় দায়! কেউ হাততালি দিচ্ছে, কেউ চিৎকার করছে। আমরা যে অফিসে, সেটাই ভুলে গেছি। মনিষ পাণ্ডে আউট হতেই আমাকে চেয়ার থেকে টেনে কোলে তুলে ফেললো কয়েকজন। হইহই অবস্থা। যে নিউজ রুমে পানির বোতল নেয়াটা পর্যন্ত নিষিদ্ধ সেখানে এক একজন চিৎকারে গলা ফাটিয়ে ফেলছে। চিল্লাচিল্লি। লাফালাফি। পারলে এখনই সবাই রাস্তায় নেমে যায় মিছিল বের করে। ১৮ ওভার শেষে ভারতের রান দরকার ৩৪।

আমাদের আর কে পায়। জিতে গেছি এটাই তখন আমাদের ভাবনা। উৎসবের কী কী নিউজ করবো সেটাই এখন একমাত্র ভাবনা। যেই দিনেশ কার্তিক রুবেলের ওভারে ছয়-চার মারা শুরু করলো। আমরা অসহায় হয়ে পড়ি। স্বপ্ন ভঙের ভয়াবহ কষ্ট চোখের সামনে। মেনে নিতে পারছি না। বুকের মধ্যে চাপ বাড়তে থাকে। শেষ পর্য়ন্ত এক ওভারে দরকার ১২ রান। প্রতিটি মুহূর্তে আমরা স্নায়ুচাপে। কী হবে, কী হবে! শেষ পর্যন্ত হাসবো নাকি মন খারাপের চূড়ান্ত অনুভূতিতে আটকে যাবো। শঙ্কায় অস্থির সবাই। সে এক ভয়াবহ অবস্থা।

২০তম ওভারের প্রথম বলেই ওয়াইড। মেজাজটাই বিগড়ে যায়। এদিকে বলে বলে আপডেট দিচ্ছি পাঠককে। একদিকে আমার পাঠক আর এক দিকে আমার মানসিক অবস্থা। আমি পাঠককে যতদ্রুত দেয়ার আপডেট দিচ্ছি । বলের আগে দু’ধরণের লেখা লিখে রাখি। একটাতে লিখি আউট হয়ে গেলেন কার্তিক। আরেকটাতে লিখে রাখি জিততে হলে দরকার এতো রান। আমি দশটা হাতে কাজ করছি মনে হচ্ছে।

পরের বল যখন ডট হয়। নিউজ রুমে হাততালির বন্যা। পরের বলে এক রান। ভিতরে ভিতরে ক্রমশ উত্তেজিত। ৪ বলে দরকার ১০। উত্তেজনায় হৃদকম্পন বন্ধ হয় হয় অবস্থা। পরের বলে ১ রান। সেকী! চিৎকার। লাফালাফিতে নিউজরুম তোলপাড়। তার পরের বলে ৪ রান। আমরা সবাই দুম করে চুপসে যাই। মুখগুলো ছোট হয়ে যায়। হাসাহাসি বন্ধ। উত্তেজনায় চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। টেনশন আর টেনশন। চাপের ওপর চাপ।

পরের বলে আউট। ইয়া আল্লাহ! কে কী করবে বুঝা বড় দায়। লাফালাফি, চিল্লাচিল্লি। হাততালি। নিউজরুমে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। তখন ১ বলে দরকার ৫ রান। এক একটা মুহূর্ত এতো বড় ক্যান তখন সেটাই মনে হচ্ছিলো। নতুন খেলোয়ার মাঠে নামতে এতো দেরি ক্যান এরকম মনে হচ্ছিলো। উত্তেজনায় স্নায়ুচাপে নিঃশ্বাস নিচ্ছিনা। দম বন্ধ করে বসে আছি।

দুই রকম আপডেট লিখে রেখেছি। …রানে ভারতকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। ….উইকেটে বাংলাদেশকে হারিয়ে ভারত চ্যাম্পিয়ন। আমি শুধু অপেক্ষায় বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন এটা পোস্ট করার।

শেষ বলে যখন কার্তিক ছয় মারলো। হা করে রইলাম। স্তব্ধ হয়ে যাই। কেমন কেমন লাগলো বুঝে উঠতে পারছিনা। আমি ভারতের চ্যাম্পিয়ন লাইনটা ফেসবুক পেজে পোস্ট করেই চেয়ারে গা এলিয়ে দেই। শরীরে কোন শক্তি নেই মনে হলো। এতোক্ষণের চেপে রাখা স্নায়ুচাপ ছেড়ে দেয়ায় আমার কেমন জানি অস্তিত্বহীন মনে হচ্ছিলো। নিউজরুমে পিনপতন নিরবতা নেমে আসে। এক একটা চেহারার দিখে তাকানো যাচ্ছে না। মাত্র ৩০ সেকেন্ড আগের অবস্থার সাথে এখনকার অবস্থা মেলানো যাচ্ছেনা।

কার কী হয়েছে, কেমন লাগছে আমি জানি না। আমার মাথাটা ফাঁকা হয়ে গেছিলো। কী করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আশাহত, গুছিয়ে রাখা স্বপ্নের ইমারত মুহূর্তের মধ্যে ধসে পড়লো। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। একটা ঘোরের মধ্যে আছি। কখনও মনে হয় স্বপ দেখছি। মনে হয়, কী করছি, কেনো করছি কিছুই মাথায় ঢুকছে না। একটা মানসিক জটিলতায় পড়ে যাই।

আমার তখন খুব করে এই মুহূর্তের জমানো কষ্টটা শেয়ার করতে ইচ্ছে হচ্ছিলো কারো সাথে। কিন্তু কার সাথে শেয়ার করবো? চরমতম নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছিলো। তখন মনে হলো আরে আমার তো কেউ নেই মন খারাপের কথাটা বলার জন্য। এই যে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এক বিশাল অনুভূতি ভিতরে জমা হয়ে গেলো। এটা বের করতে পারছি না। আমি কম্পিউটারের সামনে বসে আছি। আমি ভাবছি আমি বাসায় যাবো কিভাবে।

সাকিবরা মাঠে খেলে ওদের হয়তো এই মানসিক চাপ নেয়ার জন্য অনেক সাপোর্ট আছে। আমার, আমাদের ভিতরে যে ক্ষত তৈরি হয় তা প্রশমনের সুযোগ কি পাই?। আমার ভিতরে স্মৃতি দহন কিভাবে থামাবো। দীর্ঘদিন এই্ ক্ষত বয়ে বেড়াতে হবে।

হে সাকিব, তামিম, তোমাদের এক একটি খেলা আমার জীবনের আয়ু কমিয়ে দেয়। এতো এতো অনুভূতির চাপ সহ্য করা যায়! তবুও তোমাদের জন্য শুভ কামনা।

তালহা বিন জসিম: সাংবাদিক


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply