দালালচক্রের গুলিতেই শেষ ভাগ্য বদলের স্বপ্ন

|

স্টাফ রিপোর্টার:

ছয় ভাই বোনের সংসার মাদারীপুরের জুয়েল হাওলাদারের। ভাগ্য বদলের আশায় চার মাস আগে চার লাখ ১০ হাজার টাকার চুক্তিতে জুলহাস ও জাকিরের মাধ্যমে পাড়ি জমান লিবিয়ায়। সেখানে পৌঁছেই বুঝতে পারেন তিনি দালালের ফাঁদে পড়েছেন। এরপর শুরু হয় মাফিয়া নাটক। চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। সেই নির্যাতনের অডিও ক্লিপ পরিবারকে শুনিয়ে চাওয়া হয় আরো ১০ লাখ টাকা। পরিবারও ধার-দেনা করে এ দেশের দালালদের মাধ্যমে সে দেশের মাফিয়া গ্যাং আমির ও আবদুল্লাহর হাতে তুলে দেন দাবিকৃত পুরো টাকা। এরমধ্যেই খবর আসে দালালচক্র জুয়েলকে গুলি করে হত্যা করেছে।

শুধু জুয়েলই নয়, চাচাতো ভাই মানিক হাওলাদারও উন্নত জীবনের আশায় একই চক্রের ফাঁদে পড়েন। চক্রের হাত থেকে মুক্তি পেতে তিনিও দেন ১০ লাখ টাকা। আর একইসময় খবর আসে মর্মান্তিক মৃত্যুর।

লিবিয়ায় মানব পাচারকারীদের গুলিতে যে ২৬ জন নিহত হয়েছেন তাদের ১৩ জনই মাদারীপুর জেলার। জেলা প্রশাসকের দেয়া তালিকা ও নিহতদের পরিবারের সাথে কথা বলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
প্রিয়জন হারানোর শোক ও দেনায় জর্জরিত এই পরিবারগুলো এখন শোকে স্তব্ধ।

জুয়েলের দুলাভাই মশিউর রহমান বলেন, যে ক্যাম্পে গুলি করা হয়েছে জুয়েল সেই ক্যাম্পেই ছিল। লিবিয়া থেকে একজন ফোন করে বললো ও নেই। এরপর জুয়েলের মা-বাবাসহ কাউকেই কিছু বুঝাতে পারছি না।

জুয়েল হাওলাদারের পিতা রাজ্জাক হাওলাদার ও মা রহিমা বেগম বলেন, ‘জুয়েলসহ রাজৈর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বেশ কয়েকজনকে লিবিয়া নেয়ার কথা বলে প্রত্যেকের কাছ থেকে চার-পাঁচ লাখ টাকা চুক্তি করে তিন-চার মাস নিয়ে যায়। তারপর লিবিয়ার ত্রিপলি না নিয়ে বেনগাজী নামে এক গ্রামে আটকে রেখে নির্যাতন শুরু করে। সেখান থেকে নির্যাতনের অডিও রেকর্ড পাঠিয়ে আরো ১০ লাখ টাকা দাবি করে। আমরা হোসেনপুরের জুলহাস শেখ নামের এক দালালের বাড়িতে গিয়ে ১০ লাখ টাকা দিয়ে আসি।’

তারা বলেন, ‘এখন মানুষের কাছে শুনতেছি সেখানে অনেক বাংলাদেশিকে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের ছেলে বেঁচে আছে না মরে গেছে কিছুই জানতে পারছি না। এখন পর্যন্ত ছেলের কোনো খোঁজ পাই নাই।’

নিখোঁজ মানিক হাওলাদারের পিতা শাহ আলম হাওলাদার বলেন, ‘আমার ছেলেকে লিবিয়া নেয়ার কথা বলে জুলহাস আমার কাছ থেকে প্রথমে চার লাখ টাকা নেয়। পরে ছেলেকে বেনগাজী আটকে রেখে আরও ১০ লাখ টাকা দাবি করে। ওই টাকাও আমি জুলহাসের বাড়ি গিয়ে দিয়ে আসি। এখন আমার ছেলের কোনো খোঁজ পাচ্ছি না।’

তালিকায় থাকা বাকি হতভাগ্যরা হলেন, রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর এলাকার আবদুর রহিম, টেকেরহাট এলাকার আসাদুল, মনির হোসেন ও আয়নাল মোল্লা, ইশিবপুর এলাকার সজীব ও শাহীন, সদর উপজেলার জাকির হোসেন, জুয়েল হোসেন, সৈয়দুল, ফিরোজ ও দুধখালী এলাকার শামীম।

অনেক পরিবার জানেও না তাদের প্রিয়জন আদৌ বেঁচে আছে না মরে গেছে। অনেকে আবার হত্যাকান্ডের খবরও শোনেনি। নিখোঁজ যুবকদের সঠিক পরিচয় না পাওয়ায় তাদের পরিবারকে খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

এদিকে লিবিয়ায় হতাহতের ঘটনার খবর শুনে শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে বাংলাদেশি দালাল রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়নের মজিদ শেখের ছেলে জুলহাস শেখের বাড়িতে হামলা করে নিখোঁজ যুবকদের অভিভাবক ও এলাকাবাসী। খবর পেয়ে রাজৈর থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। পুলিশের কাছে জুলহাস শেখ নিজেকে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত বলে পরিচয় দেয়। এ সময় পুলিশ জুলহাসকে নিয়ে মাদারীপুর সদর হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করে

রাজৈর থানার ওসি শওকত জাহান বলেন, ‘জুলহাস শেখের বাড়িতে এলাকাবাসী হামলা করেছে- এমন সংবাদের ভিত্তিতে আমরা ওই বাড়িতে গেলে জুলহাস নিজেকে করোনা রোগী বলে জানায়। তখন আমরা তাকে মাদারীপুর সদর হসাপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করি।

মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, ‘লিবিয়ায় যে ২৬ জনকে হত্যার কথা শুনেছি তাদের অধিকাংশই মাদারীপুরের। তবে কতজন মারা গেছে এ তথ্য এখন পর্যন্ত প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে পাইনি। আর লাশ দ্রুত কিভাবে দেশে আনা যায় সে বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সাথে কথা বলেছি।’


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply