‘আমি এসপি বলছি ১০ হাজার টাকা লাগবে’, অবশেষে গ্রেফতার সেই প্রতারক

|

ময়মনসিংহ ব্যুরো:

হ্যালো আমি সিরাজগঞ্জের এসপি বলছি কেমন আছেন? আমারতো বদলি হয়েছে আপনার এলাকা ভালুকায়। শিল্পাঞ্চল এসপি পদে। দায়িত্ব বুঝে নিতে ভালুকা আসতে হবে। আপনার ব্যাপারে জেনেছি ভালো মানুষ আপনি। সবার কাছেতো চাওয়া যায়না। বুঝেনইতো আমাদেরতো বদনামের শেষ নেই। আপনাকে আপন মনে করে বলছি। আসবো গাড়ি ভাড়াটা আপনি একটু দিয়ে দেন। শ্রীপুরের ওসি আপনার সাথে কথা বলবে। হাজার দশেক টাকা বিকাশ করে দেন। এমন ফোন পেয়ে খুশিতে আটখানা ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার এক ব্যাক্তি (তার পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে)। স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন এসপির কাছের লোক হতে পারলে, আসছে সময়ে নানান কাজে এসপি সাহেবের সহযোগিতা পাবেন তিনি। এই সুযোগ হাতছাড়া না করতে, কালবিলম্ব নাকরে ১০ হাজার টাকা বিকাশ করে দেন তিনি।

এরপর থেকে আর খোজ খবর নেই এসপি সাহেবের, ফোনও বন্ধ। একপর্যায়ে সন্দেহ হয় তার। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন সবই ছিলো নাটক। কোন এসপি ফোন করেননি তাকে। প্রতারকের খপ্পরে পরেছেন তিনি।

অভিযোগ করেন থানায়। ঘটনাটি গুরুত্ব দিয়ে মাঠে নামে পুলিশ। জানাজায় ডিএমপি ডিবি পুলিশও হন্যে হয়ে খুঁজছে এই প্রতারককে।

অবশেষে ময়মনসিংহ জেলা গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে প্রতারক । ময়মনসিংহ জেলা গোয়েন্দা পুলিশ গত ১১ মে ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে গ্রেফতার করে তাকে নাম স্বপন মণ্ডল (৩৬)।

আগে একবার গ্রেফতার হয়েছিলো এই ব্যাক্তি। তখন অপরাধ ছিলো সাবেক ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের কণ্ঠ নকল করে ফোন দিয়ে তদবির করেছিলেন গফরগাঁও উপজেলার এক সরকারী কর্মকর্তাকে।

পুলিশ জানায়, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, প্রশাসনের কর্মকর্তার পরিচয়, মন্ত্রণালয়ের সচিব, আবার কখনও পুলিশের ডিআইজি, এসপি পরিচয়ে তাদের কণ্ঠ নকল করে ফোনে টার্গেট করা ব্যক্তির সাথে প্রতারণা করে টাকা আদায় করতো স্বপন মণ্ডল।

ডিএমপি ডিবি পুলিশের এসআই নাজিম টেলিফোনে জানান কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমেদ হোসেনের কণ্ঠ নকল করে মহিলা আওয়ামী লীগের এক নেত্রী সাজেদা বেগমকে ফোন দিয়েছিলেন এই প্রতারক। বলেছিলেন দাতব্য প্রতিষ্ঠান করবেন তিনি, তাই টাকা দরকার। আলাপচারিতার পর শান্তি নগর এলাকায় একটি কুরিয়ার থেকে পাঁচ লাখ টাকা পাঠান তিনি। ২০১৯ সালের ২৫ জুলাই রমনা থানায় এই ঘটনায় মামলা হয়। এরপর থেকে তাকে খুঁজছে পুলিশ।

মজার তথ্য হচ্ছে স্বপন মণ্ডল মানুষ ঠকানোর পাপ থেকে বাঁচতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পরেন নিয়মিত। প্রতিবার প্রতারণা করে দোয়া করেন আর যেনও এই কাজ না করতে হয়।
তার ধারনা আল্লাহকে এখনো খুশি করতে পারেননি বলেই তার দোয়া কবুল হচ্ছেনা। তাই এই পাপের পথ থেকে ফিরতে পারছেন না তিনি।

২০১৪ সালে প্রথম এভাবে মানুষ ঠকান তিনি। আইডিয়াটি মাথায় আসার পরই তিনি খুঁজতে থাকেন লোভী ব্যক্তিদের। যাদের লোভকে কাজে লাগিয়ে চালাবেন এই প্রতারণা। প্রথম ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলের সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার বলে নিজেকে পরিচয় দিয়ে ছাত্রলীগের পদ পাইয়ে দিবেন এমন আশ্বাস দিয়ে এক উপজেলা পর্যায়ের কর্মীর কাছ থেকে নিয়েছিলেন ১১ হাজার টাকা। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। সচিব, ডিসি, ইউ এনও, জেলার যখন যা দরকার তাই সেজে দিতেন ফোন। কথার ধরন আর দক্ষতায় আদায় করে নিতেন অর্থ।

এই বিষয়ে এই প্রতিবেদকের কথা হয় মনোরোগ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ডা. আবুল মনসুরের সাথে। তিনি বলেন লোভী ব্যক্তিদের সাথে প্রতারণা করা সহজ। তাদেরকে লাভবান হওয়ার স্বপ্ন দেখালে খুব সহজে ফাঁদে পা দেয়। তবে ব্যবসায়ীদের সাথে এধরনে প্রতারণা করা কঠিন। সম্মানী ব্যক্তিদের সাথে প্রতারণা করলে ধরা পরার সম্ভাবনা কম। নিজের সম্মানহানীর ভয়ে প্রতারিত হওয়ার পর মুখ খুলেন না তারা, শরণাপন্ন হন না পুলিশের।

জানা গেছে প্রতারণার খবর জানতে পেরে স্ত্রী একমাত্র সন্তানকে নিয়ে, স্বামীকে তালাক দিয়ে চলে গেছে ইতিমধ্যে। স্বপন মণ্ডলের দুঃখ স্ত্রীকে সংসারে রাখতে ব্যর্থ তিনি।

ভালুকার উড়াহাটি গ্রামের মৃত-সালাউদ্দিন মণ্ডলের ছেলে স্বপন মণ্ডল। কমার্স থেকে সেকেন্ড ক্লাস পেয়ে ১৯৯৭ সালে এস এস সি পাশ করেন। একপর্যায়ে বালু সাপ্লাইয়ের ব্যবসা করে লস খেয়ে শুরু করেন প্রতারণার এই কৌশল। তার বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে এমন আরও ভুক্তভোগীর খোজ পাওয়া যায়। তবে মান সম্মানের ক্ষতি হবে বলে তারা কেও পরিচয় প্রকাশে রাজি হননি।

ময়মনসিংহ জেলা গোয়েন্দা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ শাহ কামাল আকন্দ জানান, স্বপন মণ্ডল বড় সরকারি কর্মকর্তাদের কণ্ঠ নকল করে মানুষের সাথে প্রতারণা করে টাকা আদায় করে আসছিলো। মোট ১৬ টি মোবাইল নাম্বার পাওয়া গেছে তার কাছ থেকে। এসব নাম্বার দিয়ে মানুষের সাথে প্রতারণা করে আসছে। তাকে তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তার বিকাশ নাম্বারে ৬০ হাজার টাকা পাওয়া যায়। যা, ভালুকা পৌরসভার এক কাউন্সিলরের কাছ থেকে প্রতারণা করে নিয়েছিলো স্বপন মণ্ডল। তার বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা দায়ের করা হয়েছে। তার মোবাইল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, উক্ত মোবাইলে কয়েক দিনে ১৪ টি সিম ব্যবহৃত হয়। নম্বর গুলো হচ্ছে ০১৭২৯-৯৪৫৯৭৩ ০১৭৬৬-৪২৮৩২৪, ০১৩১৪-৭৯৩০৬৪, ০১৭১১-০৭৪৮৭৪, ০১৩১৬-০৯৮৬৭২, ০১৯৯৫-৩৯৯০২৮, ০১৯০৭-৭৪১৭১৪, ০১৯১৫-৯৮৫১১৩, ০১৪০২-৬৫৪৪০৮, ০১৩১৭-৯৪৪৭৬৩, ০১৭৬৫-৩৩৭৫৭৫, ০১৭৩৫-৮৮৬৭৩৩, ০১৩১৩-৮৬৫৯৩৪,০১৯০৬-৯২৪৪৬৩।
এই নাম্বার গুলো ব্যবহার করে সে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ইতিপূর্বে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা আছে।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply