গৃহস্থালী ও হাসপাতাল বর্জ্য থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে

|

গৃহস্থালী ও হাসপাতাল বর্জ্য থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীরা বাসাবাড়িতে কোয়ারেন্টাইনে আছেন। ক্ষেত্রবিশেষে আইসোলেশনও বাসায় হচ্ছে। এছাড়া দেশের সব হাসপাতালের আবর্জনাও আলাদাভাবে সংগ্রহ করে ব্যবস্থাপনা করার পদ্ধতি গড়ে ওঠেনি। এমতাবস্থায় করোনা রোগীদের ব্যবহৃত টিস্যু বা অন্য আবর্জনা সাধারণ আবর্জনার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। এতে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার বড় ধরনের ঝুঁকি রয়েছে। এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার পাশাপাশি এই ঝুঁকি মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দেশের ১২টি সিটি কর্পোরেশন এবং ৩২৮টি পৌরসভায় বাসাবাড়ি থেকে আবর্জনা সংগ্রহ করা হয়। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনসহ কয়েকটি সিটি কর্পোরেশন এবং পৌরসভার আবর্জনা পরিবেশ সম্মতভাবে ব্যবস্থাপনা করা হয়। তবে মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চিত্র বেহাল। ঢাকা, টঙ্গী এবং নারায়ণগঞ্জের মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য একটি কাঠামো গড়ে উঠলেও সেটা এক হাজার ৫০০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সর্বোচ্চ এক হাজার প্রতিষ্ঠানের আবর্জনা সংগ্রহ করতে পারে। বাকি প্রতিষ্ঠানের আবর্জনা সাধারণ আবর্জনার সঙ্গে মিশে ল্যান্ডফিলে ফেলা হয়। দেশের অন্য সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভায় এ কার্যক্রম খুবই স্বল্প পরিসরে রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

অন্য দিকে দেশের বৃহৎ অংশজুড়ে থাকা নাগরিক সেবা প্রতিষ্ঠান চার হাজার ৫৭১টি ইউনিয়নে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার তেমন কোনো কাঠামো এখনো গড়ে ওঠেনি। করোনাভাইরাস দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ায় গ্রামবাংলায় যত্রতত্র ফেলানো আবর্জনা থেকেও ভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকি রয়েছে। এসব কিভাবে ব্যবস্থাপনা করা হবে, সেসব ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে এখনও তেমন কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি।

দেশের সামগ্রিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চিত্র সম্পর্কে স্থানীয় সরকার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, বর্জ্য থেকে করোনাভাইরাস ছড়াচ্ছে কিনা, এখনও সেটা প্রমাণিত নয়। তবে যেভাবে ছড়ায় বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন। তাতে করে বর্জ্য থেকে করোনাভাইরাস ছড়ানো অসম্ভব কিছু না। এসব কথাও বিভিন্ন পর্যায় থেকে আমাদের কাছে আসছে। সেসব পর্যালোচনা করছি। প্রয়োজন হলে এ ব্যাপারে আমরা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে সতর্ক করব। এছাড়া সংশ্লিষ্টদের এবং সর্বোপরি দেশবাসীকে সতর্ক এবং সচেতন করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

মন্ত্রী বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে শহর পর্যায়ে একটি কাঠামো গড়ে উঠলেও গ্রাম পর্যায়ে এখনও সেটা হয়ে ওঠেনি। এরপর মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমও সর্বত্র গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। চেষ্টা চলছে, ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় এটা সম্ভব হবে। তবে সেটা সময়সাপেক্ষ বিষয়।

তাজুল ইসলাম আরও বলেন, করোনাভাইরাস কিভাবে ছড়ায় সেটা নিয়ে নানারকম কথা শোনা যাচ্ছে। একেক সময় একেক রকম কথা শুনছি আমরা। সেসব পর্যালোচনা করছি, যেসব বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া প্রয়োজন আমরা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান এবং ডিসিদের সেসব নির্দেশনা দিচ্ছি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, গৃহস্থালীর বর্জ্য বা হাসপাতাল বর্জ্য যাই বলি না কেন? আবর্জনা বা নোংরা পরিবেশ থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া শুরু হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ তার বড় উদাহরণ। তিনি বলেন, এ সময় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নইলে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যেতে পারে।

এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, আমাদের দেশে যেভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা হয়, তাতে মনে হয় বর্জ্য থেকে খুব সহজে করোনাভাইরাস নিম্নশ্রেণির মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তিনি বলেন, নারায়ণগঞ্জে করোনাভাইরাস ভয়াবহ রূপ ধারণ করার পেছনে অনেক কারণের মধ্যে বর্জ্য বা নোংরা পরিবেশও অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে। এজন্য এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক হতে হবে এবং এটা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

বিশেষজ্ঞদের এ শঙ্কার সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা। এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল হাসনাত মো. আশরাফুল আলম বলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীরা হাসপাতালে যাওয়ার আগে ১০-১৫ দিন বাসায় থাকছেন। ওইসব বাসার গৃহস্থালীর বর্জ্যগুলো সাধারণ বর্জ্যরে সঙ্গে সংগ্রহ করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ যে, বাসাবাড়ি থেকে যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা বর্জ্য সংগ্রহ করেন; তারা এসব বর্জ্য থেকে মূল্যবান জিনিসপত্র আলাদা করে নেন, যেমন-প্লাস্টিক, লোহা বা অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী। এ সময় তারা আক্রান্ত হয়ে যেতে পারেন। এ ছাড়াও বর্জ্য সংগ্রহের সময়েও সংক্রমণ হতে পারে।

তিনি বলেন, বর্জ্য থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে আমরা উত্তর সিটির পক্ষ থেকে আমিন বাজার ল্যান্ডফিলে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছি। কিন্তু বর্জ্য সংগ্রহের সময় সেখান থেকে জিনিসপত্র সংগ্রহ থেকে তো তাদের বিরত রাখা যাবে না। কেননা, তারা এসব কাজ করে যে টাকা পায়, তার চেয়ে বেশি আয় করে বিভিন্ন ধরনের দ্রব্যসামগ্রী বিক্রি করে।

এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ও মাতুয়াইল ল্যান্ডফিলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা প্রকৌশলী আ.হ.ম আবদুল্লাহ হারুন বলেন, যেভাবে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এতে করে আমাদের আশঙ্কা হচ্ছে, বর্জ্য থেকেও এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। এজন্য আমরা মাতুয়াইল ল্যান্ডফিলে বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছি। বর্জ্য সংগ্রহের সঙ্গে জড়িতদের এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছি। এতে কতটুকু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে, সেটা বলা মুশকিল।

সম্প্রতি চীনা বিজ্ঞানীদের এক গবেষণায় দেখা গেছে, উহানের একটি হাসপাতালের মেঝেতেই সবচেয়ে বেশি করোনাভাইরাস পড়েছিল। এছাড়া ভাইরাস পাওয়া গেছে কম্পিউটারের মাউস, ডাস্টবিন, বিছানা ও দরজার হাতলে। এ কারণে হাসপাতাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করার প্রতি জোর দেন গবেষকরা। গত বছরের ডিসেম্বরে উহানে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর সেখানে হাসপাতালের বিভিন্ন বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলা হয় বলে বিশ্ব গণমাধ্যমের খবরে জানা গেছে।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply