করোনাভাইরাস: মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরা এক বাংলাদেশি ডাক্তারের অভিজ্ঞতা

|

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা ড. সুনীল রায় গত ৪৫ বছর ধরে ইংল্যান্ডের জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় (এনএইচএস) একজন গ্যাস্ট্রো-এনট্রোলজিস্ট হিসাবে কাজ করছেন। সেখানেই চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে ৭২ বছর বয়সী এই চিকিৎসক সম্প্রতি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। হাসপাতালের আইসিইউতে মৃত্যুর সাথে তাকে পাঞ্জা লড়ে ফিরে এসেছেন। সেই অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসিকে বলেছেন তিনি। জানিয়েছেন, কত বিপজ্জনক নতুন এই ভাইরাস এবং কতটা হুমকিতে রয়েছেন ডাক্তাররা।

ডা. সুনীল রায়ের জবানিতে সেই অভিজ্ঞতা যমুনা অনলাইনের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

১২ মার্চ থেকে গলাব্যাথা এবং সেইসাথে কাশি ও জ্বর। বুঝতে পারছিলাম কোভিড নাইনটিনের লক্ষণ। দু’দিন পর হাসপাতালে কোভিড-১৯ নমুনা নেওয়ার পর আমাকে হাসপাতালে রেখে দেওয়া হলো। ১৫ মার্চ আমাকে জানালো হলো আমি করোনা পজেটিভ। আমার পরিস্থিতি দ্রুত খারাপের দিকে যেতে থাকে। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা দ্রুত পড়তে থাকে। আমি ডাক্তার বলে অন্য ডাক্তাররা আমাকে অবস্থা জানাচ্ছিলেন।

এক পর্যায়ে আইসিইউ-এর একজন কনসালটেন্ট এসে বললেন, তোমার যে অবস্থা তাতে তোমাকে আইসিইউতে নিতে হবে। তোমাকে অতিরিক্ত অক্সিজেন দিতে হবে। তাতে কাজ না হলে ভেন্টিলেটরে নিতে হবে।

আইসিইউতে নেওয়ার কথা শুনে বেশ ভয় পেয়ে যাই আমি। কারণ ডাক্তার হিসাবে আমি জানি সেখান থেকে বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা ফিফটি-ফিফটি। আর ভেন্টিলেশনে নিলে সম্ভাবনা আরো কম।

ডাক্তারদের বললাম, আইসিইউতে যাওয়ার আগে আমি আমার স্ত্রী এবং ছেলে মেয়ের সাথে কথা বলতে চাই। তখন আমাকে জানালো হলো আমার স্ত্রীও হাসপাতালে পাশের ওয়ার্ডে। তাতে আরও ভয় পেয়ে গেলাম।

আমার এক ডাক্তার মেয়ে ১০ বছর আগে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেছে। আমি ভাবছিলাম এখন যদি আমাদের স্বামী-স্ত্রী দুজনেরই কিছু হয়ে যায়, আমার বাকি দুই ছেলে-মেয়ে তো অসহায় হয়ে পড়বে! ওদের কী হবে! তখনকার মনের অবস্থা আমি বোঝাতে পারবো না। আমি জানি এই রোগের তো কোনো চিকিৎসা নেই। শুধু শরীরের ইমিউন শক্তির ওপর ভরসা করতে হবে।

আমি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলাম। ভারতীয় রেডক্রসে যোগ দিয়ে ত্রিপুরায় কাজ করেছি। হাসপাতালে শুয়ে আামার সেদিন মনে হচ্ছিল আমি যেন আরেক যুদ্ধের মুখোমুখি হলাম।

আইসিইউতে থাকার অভিজ্ঞতা

আমাকে আইসিইউ ওয়ার্ডে নেওয়া হলো এবং বাড়তি অক্সিজেন দিয়ে রাখা হচ্ছিল। ২৪ ঘণ্টা পর ডাক্তার বললো তোমার অগ্রগতি ভালো হচ্ছে। সৌভাগ্য যে ভেন্টিলেটরে যেতে হলো না। একদিন পর আমাকে ওয়ার্ডে নেওয়া হলো।

আইসিইউ থেকে বের করে আনার সময় নার্স-ডাক্তাররা আমাকে বলছিল, এই ওয়ার্ডে যারা আসে তাদের সবাই জীবিত বের হয়ে যেতে পারে না। তুমি যে যেতে পারছো তাতে আমরা খুবই খুশি। তোমাকে যেন আর এখানে না আসতে হয়।

এর ১৪/১৫ দিন পর বাড়িতে এসে এখন সবাই সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং মেনটেইন করে রয়েছি।

ডাক্তারদের সুরক্ষা

আমি সংক্রমিত হওয়ার প্রায় এক মাস হয়েছে। তখনও ডাক্তারদের পিপিই নিয়ে কোনো কথাই হচ্ছিল না এদেশে। আমরা খোঁজ করলে বলা হতো ‘আসছে’। আমি মনে করি এখনো যে পরিমাণ পিপিই ডাক্তার-নার্সদের দেয়া হচ্ছে, একেবারেই যথেষ্ট নয়।

একটা ধারণা ছিল কম-বয়সীদের এটা হয় না, কিন্তু আমি আইসিইউতে থাকার সময় দেখেছি ওখানে অনেক কম-বয়সী রোগী মৃত্যুর সাথে লড়ছে। আমার মনে হয় না সরকারের কোনো ধারণা ছিল পিপিই সম্পর্কে। সরকার বোধহয় বোঝেইনি জিনিসটা কতটা জরুরি। তারা হয়তো ভাবেইনি যে এভাবে করোনাভাইরাস এদেশে এসে এত দ্রুত হানা দেবে।

সবচেয়ে বড় কথা ভাইরাস সংক্রমণের পরীক্ষা ঠিকমতো করা হচ্ছে না। এই যে আমার মেয়ে এখন আমাদের কাছে আসছে। তারপর কাজে যাচ্ছে। তার তো পরীক্ষা হচ্ছে না। পরীক্ষা হলে পজেটিভ রোগীদের আলাদা করে ফেলা যেত, ফলে অন্যরা সংক্রমিত হতো না। জার্মানি সেই কাজটাই করছে, কিন্তু ব্রিটেনে তা হচ্ছে না।

ডাক্তার হয়েও সবদিক দিয়ে কেমন যেন অসহায় বোধ করছি। এই ভাইরাসের তো কোনো চিকিৎসা নেই। আমরা ডাক্তাররা এখনো বুঝতে পারছি না কী চিকিৎসা করবো। মূলত আক্রান্তের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপরই ভরসা করতে হচ্ছে। মনে হয়, ঈশ্বরের কৃপা ছাড়া বোধ হয় এখন কোনো পথ নেই। এটা যেন অনেকটা টোট্যাল সারেন্ডার, আত্মসমর্পণ।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply