করোনা শঙ্কায় যেভাবে চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেলেন স্কুল শিক্ষিকা

|

নাজমুল হোসেন:

বিকেলে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমানের ফোন এলো। কুশলাদি বিনিময়ে পর তিনি আমাকে একজন রোগীর ব্যাপারে খোঁজ নিতে অনুরোধ করেন। পুলিশে সজ্জন এবং প্রভাবশালী অফিসার হয়ে একজন ডিআইজি পদমর্যাদার অফিসার একজন রোগীর খোঁজ নিতে অনুরোধ করায় অবাক হলাম।

খোঁজ নিয়ে জানলাম রোগীর নাম মাহমুদা বেগম। বাড়ি গোপালগঞ্জ সদরে। তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষিকা। নিউমোনিয়ার রোগী। গত চার বছর রাজধানীর এ্যাপোলো হাসপাতালেই চেকআপ করাতেন। বুধবার সকালে হঠাৎ শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে সন্তানেরা রাজধানীর এভারকেয়ার (পূর্বের নাম এ্যাপোলো) হাসপাতালে ভর্তি করান। কিন্তু রাত আটটা অবধি বৃদ্ধাকে জরুরি বিভাগেই রাখা হয়। ডিউটি ডাক্তার লাইফ সাপোর্টের প্রয়োজনের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু করোনা রোগী সন্দেহে জরুরি বিভাগেই রাখা হয় মাহমুদা বেগমকে।ডিআইজি হাবিবুর রহমান হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে অনবরত অনুরোধ জানিয়েও কোন কাজ হয়নি। সাত ঘণ্টায় দশ হাজার টাকা বিল ধরিয়ে দিয়ে রোগীকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে চাপ দেয়া হয়।

পরে উপায়ান্তর না দেখে স্কুল শিক্ষিকা মাহমুদা বেগমের ছেলে সৈয়দ শাহীন এবং মেয়ে চম্পা খাতুন কয়েকটি হাসপাতালে যোগাযোগ করেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী সরকারি হাসপাতালে ভর্তির সুযোগ থাকলেও সেখানে আইসিইউ সুবিধা নেই। অনেক সময় ধরে সুচিকিৎসা বঞ্চিত বর্ষীয়ান নারীর অবস্থা আরো সংকটাপন্ন হয়ে যায়। অবশেষে মগবাজারের রাশমনো হাসপাতালে রোগী নেয়ার অনুমতি মেলে।

এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে যমুনা টেলিভিশনের গাড়িতে আমরাও অ্যাম্বুলেন্সকে অনুসরণ করলাম।

রাতের নীরবতা ভেঙে সুনসান ঢাকার রাস্তায় এগিয়ে চলে অ্যাম্বুলেন্স। উদ্বিগ্ন দুই সন্তান আর স্বজনেরা। দশ মিনিটেই মগবাজারের রাশমনো হাসপাতালে এসে উপস্থিত হয় অ্যাম্বুলেন্স। রোগীকে নামিয়ে নেয়া হয় পঞ্চম তলায় আইসিইউর সামনে। সেখানে শুরু হয় নতুন টানাপোড়ন।

রাশমনো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সাফ জানিয়ে দেয় রোগীকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। কারণ এভারকেয়ার হাসপাতাল (পূর্বের এ্যাপোলো) লিখে দিয়েছে রোগীর লাইফ সাপোর্ট প্রয়োজন। সেই সুবিধা নেই রাশমনোতে। এরমধ্যে আমি আইসিইউতে উঁকি দিয়ে দেখি চারটি বেড ফাঁকা পড়ে আছে। কিন্তু আইসিইউয়ের ডিউটি ডাক্তারের সাফ জবাব ভেন্টিলেশনের সুবিধা নেই। রোগী অন্যত্র নিতে হবে।

এরমধ্যে রমনা থানা থেকে কয়েকজন পুলিশ অফিসার এসে রোগীর চিকিৎসা শুরু করার অনেক অনুরোধ জানান। কিন্তু তাতেও মন গলেনি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। তাদের ধারণা রোগী করোনায় আক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু মাহমুদা বেগমের ছেলে ও মেয়ে জানান, তাদের মা অনেকদিন ধরেই শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। তাদের বাসায় বিদেশ ফেরতে কেউই আসেনি।
স্বজনেরা বন্ড সই দিতে রাজি থাকলেও তরুণ চিকিৎসক ঝুঁকি নিতে নারাজ। সময় গড়িয়ে যায়; কিন্তু রোগীর কাছে যাননি কোন চিকিৎসক। আস্তে আস্তের নিস্তেজ হয়ে যায় মাহমুদা বেগমের শরীর।

রাত সাড়ে দশটার দিকে অবশেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন বৃদ্ধা মাহমুদা বেগম। করোনা রোগী সন্দেহে কোন চিকিৎসক তাকে দেখতে আসেনি। এরপর হাসপাতালের নিচতলায় লাশ রেখে সটকে পড়েন চিকিৎসক ও হাসপাতালের স্টাফরা।

বৃদ্ধার ছেলে সৈয়দ শাহীন আক্ষেপ করে বলেন, টাকা দিয়েও মায়ের চিকিৎসা করাতে পারলাম না। এই রাষ্ট্রের মানুষ এত অসহায় কেন? হাসপাতালে উপস্থিত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ সদস্য জানালেন, করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে পুলিশ রাতদিন মাঠে কাজ করলেও অনেক সাধারণ রোগীকে চিকিৎসা বঞ্চিত হতে দেখছেন। কিন্তু এই ভাইরাসে আক্রান্তদের সুচিকিৎসার জন্য চিকিৎসকেরাই ফ্রন্ট লাইনের যোদ্ধা।

বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু–সাংবাদিকতার নীতিমালায় এই বাক্য লেখা নিষেধ। কিন্তু খুব কাছ থেকে দেখলাম, সামর্থ্য থাকার পরও একটি সচ্ছল পরিবারের সিনিয়র সিটিজেন কিভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। অথচ তার শিক্ষকতা জীবনে শিক্ষার্থীর অনেকেই চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত।

পুনশ্চ: মাহমুদা বেগমের মৃত্যুর পর তার লাশ দাফনে তৈরি হবে নতুন জটিলতা।

লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, যমুনা টেলিভিশন।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply