ক্ষুধার্ত স্বামীকে শিকলবন্দী; ভাইরাসে মরতে অইবো না, আমরা উপোসে মইরা যামু

|

আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় অন্ধ পল্লীর সুবিধাবঞ্চিত মানুষগুলো স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি নিয়ে যতটা না উদ্বিগ্ন, তার থেকে অনেক বেশি উৎকণ্ঠিত খাদ্য কিংবা পেটের ক্ষুধা নিয়ে। তাদের একটাই কথা ‘ট্রেন বন্ধ থাকলে আমরা খামু কেমনে? বউ-বাচ্চারে কী খাওয়ামু? ভিক্ষা করতে গ্রামে বের হলে করোনাভাইরাস সংক্রমণ আতঙ্কে মানুষ ভিক্ষা না দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। আমাদেরকে করোনাভাইরাসে মরতে অইবো না। কিছুদিন এমনভাবে চললে আমরা এমনেই না খাইয়া মইরা যামু’ -এমন করেই কথাগুলো বলছিলেন আখাউড়া উপজেলা শাখার জাতীয় অন্ধ কল্যাণ ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক মুকবুল মিয়া (৬০)।

জানাগেছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে আখাউড়ায় মানবেতর জীবন যাপন করছে অন্ধ পল্লীর বাসিন্দারা। উপজেলার উত্তর ইউনিয়নের রামধনগর গ্রামের অন্ধ পল্লীর ৪০টি পরিবারে ছেলে-বুড়ো, শিশু ও মহিলা নিয়ে অন্তত শতাধিক অন্ধ সুবিধাবঞ্চিত ভিক্ষুক আখাউড়া রেলওয়ে জংশন স্টেশনের ট্রেনযাত্রীদের ওপর নির্ভরশীল। ওই অন্ধরা আখাউড়া রেলওয়ে স্টেশন হয়ে চলাচলকারী বিভিন্ন আন্তঃনগর, মেইল ও লোকাল ট্রেন যাত্রীদের কাছে হাত পেতে যা পায় তা দিয়ে চলে তাদের সংসার। করোনা মহামারীর কারণে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় অন্ধ পল্লীর বাসিন্দাদের স্টেশনে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ভিক্ষা করতে গ্রামে বের হলে করোনাভাইরাস আতঙ্কে গ্রামের মানুষ ভিক্ষা না দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। তাই বাধ্য হয়ে দিন আনে দিন খায় অন্ধ জনগোষ্ঠীর আয়ের পথ থমকে গিয়ে তারা ঘরবন্দি হয়ে যায়।

অন্ধ পল্লীর রমজান আলী, ওলি আহম্মদ, হোসেন আলী, লাভলী আক্তার, জোহরা বেগম, হাসিনা আক্তার, নার্গিস বেগমসহ ক্ষুধার্ত ভিক্ষুকরা এ প্রতিবেদককে জানান, ঘরে যা সঞ্চয় ও মজুদ ছিল সব ফুরিয়ে গেছে। বাঁচার তাগিদে ভিক্ষা করতে গ্রামে গেলেও ভাইরাস সংক্রামণের ভয়ে কেউ ভিক্ষা দেয়না। ঘরে খাবারের কিছু না থাকায় রান্নাও বন্ধ। কালো মিয়া প্রচণ্ড ক্ষুধার যন্ত্রণা নিয়ে স্ত্রী লাভলীর কাছে খাবার খোঁজে না পেয়ে তাকে মারধর করে। ঘরের হাড়ি পাতিল ভাঙচুর শুরু করে। অন্ধ পল্লীর অন্যদের সহায়তায় দু’দিন হল স্বামীকে শিকলবন্দী করে রাখে স্ত্রী লাভলী।

শিকলবন্দী কালো মিয়ার স্ত্রী লাভলী আক্তার জানান, গ্রামের এক লোকের বাড়িতে তিনি গৃহকর্মীর কাজ করতেন। করোনাভাইরাস সংক্রমণ আতঙ্কে ওই বাড়ির লোকজন তাকে যেতে নিষেধ করেছেন। ঘরে চাল-ডাল যা ছিল এতোদিনে তা ফুরিয়ে গেছে। আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সংসারে রান্নাও বন্ধ। স্বামী, সন্তান নিয়ে উপোস দিন কাটছে তাদের। লাভলীর মতো অন্ধ পল্লীর অন্যরাও জানান, সংসার চালানোই কঠিন হয়ে পড়েছে তাদের সবার। প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি কিংবা সমাজের ভিত্তবানরাও এগিয়ে আসছেন না। চরম বিপাকে পড়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে অন্ধ পল্লীর বাসিন্দারা। এখন অন্ধদের একটিই কথা, আর কিছুদিন এভাবে চলতে থাকলে ভাইরাস মরতে অইবো না, এমনিতেই আমাদের না খেয়ে মরতে অইবো’।

আখাউড়া উপজেলা অন্ধ কল্যাণ ফাউন্ডেশনের সহসভাপতি করিম শেখ (৬৫) বলেন, ক’দিন ধরে বউ পোলা-মাইয়্যা নিয়া খেয়ে না খেয়ে ঘরে শুয়ে-বসে সময় পার করছি। একদিন খালি (শুধু) মুখোশ (মাস্ক) আর হাতধোয়ার ঔষুধ দিয়ে গেছে। পেটে দেয়ার মতো খাবার তো কেউ দেয় না। ক্ষুধার জ্বালা আর সহ্য হচ্ছে না। তিনি বলেন, আর যদি কিছুদিন এমনিতে চলতে থাকি তাইলে ভাইরাসে মরতে অইবো না আমরা ঘরবন্দী থাইকা উপোসে মইরা যামু’।

আখাউড়া উত্তর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হান্নান ভূঁইয়া স্বপন বলেন, সরকারী কোন বরাদ্দ এখনও পাইনি। তবে সমাজের সুবিধাবঞ্চিতদের একটি তালিকা করেছি। খুব দ্রুতই তাদের মাঝে কিছু শুকনা খাবার বিতরণ করা হবে।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply