করোনা ঠেকাতে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেই রেলের

|

বিশ্বজুড়ে করোনা আতঙ্ক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতিমধ্যেই করোনাভাইরাসকে মহামারী ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশেও ৩ জন করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। বিদেশ ফেরত বহু মানুষকে কোয়ারেন্টিনে রাখা হয়েছে। দেশজুড়ে চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি।

কিন্তু বাংলাদেশ রেলওয়ে কতটা প্রস্তুত? প্রতিদিন ৯ লাখ যাত্রী ট্রেনে যাতায়াত করছেন। সরকার জনসমাগম এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিলেও লাইন ধরে টিকিট সংগ্রহ, হুড়োহুড়ি ও গাদাগাদি করে হাতল ধরে ট্রেনে উঠানামা, প্রতিটি কামরায় অতিরিক্ত যাত্রী বহন এবং কামরা ও টয়লেটগুলো অপরিচ্ছন্ন হওয়ায় করোনা ঝুঁকিতে ট্রেনযাত্রীরা।

এসব মোকাবেলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেই রেলের। প্ল্যাটফর্মগুলোর দিকে ভালো করে তাকালেই চোখে পড়বে মলমূত্র ও আবর্জনা। আক্রান্ত দেশগুলোতে যেভাবে যাত্রী উঠার আগে ট্রেনগুলো স্প্রে করা হচ্ছে, পরিচ্ছন্নতার ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে তার কোনো আলামত চোখে পড়ল না। ফলে ঝুঁকি নিয়েই চলছে যাত্রীরা।

রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়লে ট্রেন বন্ধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। আপাতত সচেতনতামূলক প্রচারকেই গুরুত্ব দিচ্ছে রেল। তবে কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে আক্রান্ত চীন, ইতালি, ইরান ও দক্ষিণ কোরিয়াসহ ১৩ দেশের যাত্রীদের ঢাকা-কলকাতা, খুলনা-কলকাতাগামী ট্রেনের টিকিট না দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

কথা হয় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোফাজ্জেল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধে দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছে। বুধবার বিকালেও রেলপথমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বিশেষ বৈঠক হয়। আমরা প্রতিটি স্টেশনে সচেতনতামূলক প্রচারপত্র বিতরণ, ব্যানার পোস্টার লাগাচ্ছি।

ট্রেনের ভেতরে এবং স্টেশনে থাকা ডিজিটাল মনিটরে সচেতনতামূলক ভিডিও ক্লিপ ছাড়া হচ্ছে। স্টেশন ও ট্রেন পরিষ্কার নিশ্চিত করতে মনিটরিং সেল করা হয়েছে। কারও গাফলতি পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, পরিস্থিতি ভয়াবহের দিকে গেলে ট্রেন বন্ধ করে দেয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।

রেলওয়ে মহাপরিচালক শামছুজ্জামান জানান- স্টেশন, ট্রেন সব সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ার পর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা আরও নিশ্চিত করতে হবে। যাদের গাফিলতি থাকবে- ব্যবস্থা নেয়া হবে। সবাইকে মিলেই করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করতে হবে। রেলযাত্রীদের আর কীভাবে সচেতন করা যায়, তা নিয়ে বারবার বৈঠক হচ্ছে। আমরা সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছি।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ে প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. সামসুল আলম ইমতিয়াজ জানান, ট্রেনে যাতায়াতের সময় যাত্রীদের সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আমাদের আসলে তেমন কিছু করার নেই। তবে আতঙ্কিত না হয়ে তা মোকাবেলা করতে হবে। সতর্ক হতে হবে। শীর্ষ কর্মকর্তাদের নির্দেশমতো রেলওয়ে হাসপাতালগুলো প্রস্তুত করা হচ্ছে।

গত ২ দিন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ঘুরে দেখা গেছে, শত শত যাত্রী কাউন্টারে গাদাগাদি করে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট নিচ্ছেন। এছাড়া ট্রেন স্টেশনে আসা মাত্রই হুড়মুড় করে যাত্রীরা উঠছেন-নামছেন। স্বাস্থ্য অধিদফতর ভিড় এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিলেও ট্রেনের যাত্রী ব্যবস্থাপনায় সেরকম কিছু চোখে পড়েনি।

কোনো কোনো ট্রেন ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ যাত্রী নিয়ে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে। তাছাড়া একটি ট্রেন গন্তব্যে আসার পর ভেতরটা পরিষ্কার করা বা স্প্রে করার কোনো ব্যবস্থা নেই। বরং প্রায় প্রতিটি কক্ষে একটি আসন ঘিরে একাধিক যাত্রীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। টয়লেট ব্যবহারেও সচেতনতার অভাব দেখা গেছে।

সাবান-টিস্যুর তো বালাই-ই নেই। বাথরুমের এখানে-সেখানে থাকা মলমূত্র পরিষ্কার করার কোনো তৎপরতাও চোখে পড়েনি। বুধবার দুপুরে কমলাপুর স্টেশনের ৭ নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা বনলতা এক্সপ্রেস ঘুরে দেখা গেল, এসি কোচ ও এসি কেবিন কোচগুলোর টয়লেটে কিছু সাবান দেখা গেলেও বাকি কোচগুলোতে সাবানের চিহ্ন পর্যন্ত নেই।

অনেক সিটে ময়লা লেগে আছে। এছাড়া সিটের মাথা রাখার স্থানটি ময়লায় কালচে হয়ে আছে। হাতলগুলোর একই হাল। প্রতিটি ফ্যান ধুলাবালুতে পূর্ণ। ট্রেনের পরিচালক (গার্ড) হিল্লুল জানান, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর নিজের পয়সায় সাবান ও হ্যান্ডওয়াশ কিনেছি।

তিনি বলেন, টয়লেটে সাবান-টিস্যু দেয়া হলেও এগুলো চুরি হয়ে যায়। যাত্রীরা টয়লেট ব্যবহার করতে গিয়ে নোংরা করছে। প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেনে ঢোকার দরজা উপরে থাকায় প্রতিটি যাত্রীকে হাতল ধরে উঠতে-নামতে হচ্ছে।

ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস ট্রেনের অবস্থা আরও খারাপ। গোটা ট্রেনটাই যেন ময়লার ভাগাড়। কোনো সিট তার দিয়ে বাঁধা, কোনোটি আবার যে কোনো সময় খুলে পড়ার অবস্থা। টয়লেটগুলোর ভেতর তাকানো যায় না, দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল। স্টেশনে আসার পর ছাদে থাকা সবক’টি ট্রেনের ট্যাংকিতে পানি ভরা হয়। এ কাজে সম্পৃক্ত শ্রমিকরা জানান, প্রায় সব ট্রেনের ট্যাংকির ঢাকনা খোলা, চুরি হয়ে গেছে।

জানতে চাইলে পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ডা. আনিসুল হক জানান, আমাদের সরঞ্জামে ঘাটতি রয়েছে। তবে উপরের নির্দেশনা মোতাবেক কাজ করছি। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে ট্রেন যাত্রীদের সচেতন কিংবা সহযোগিতা করলেও সুফল মিলবে না।

কেননা টিকিট কাটা, স্টেশনে প্রবেশ-বাহির, ট্রেনে উঠানামা থেকে শুরু করে প্রতিটি পদেই যাত্রীদের গাদাগাদি অবস্থা। আমরা এখন ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা চালিয়ে যাচ্ছি। আধুনিক পদ্ধতির কোনো বিকল্প নেই।

প্লাটফর্মে যাত্রীদের পানি খাওয়ার ব্যবস্থা থাকলে গ্লাসগুলো শিকলে বাঁধা। শত শত যাত্রী এসব গ্লাসেই পানি খাচ্ছেন। বুধবার প্ল্যাটফর্ম থেকে বের হওয়ার গেটের (দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির গেট) সামনের ফ্লোর সংস্কার করছিলেন কয়েকজন শ্রমিক। কাটিং মেশিন দিয়ে আস্তর কাটা এবং উঠানোর শব্দে যাত্রীদের মধ্যে একরকম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছিল।

পুরো প্ল্যাটফর্মে ধুলা উড়ছিল। জানতে চাইলে শ্রমিকরা বলেন- ঠিকাদারের অর্ডার, কাজ চালিয়ে যেতে হবে। একপর্যায়ে বিষয়টি রেল সচিবকে জানানোর পর কাজটি বন্ধ করা হয়।

৩নং প্ল্যাটফর্ম ঘেঁষা লাইনের আশপাশে দেখা গেল মলমূত্র, ময়লা-আবর্জনার স্তূপ। দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা জানান, আমরা ট্রেনের ভেতরটা পরিষ্কার করি, প্ল্যাটফর্ম এবং লাইন এলাকা পরিষ্কার করেন অন্যরা। আবার পরিষ্কার করা নিয়ে দোষারোপ করতেও দেখা গেল।

বুধবার দুপুর ২টার দিকে এখানকার প্রথম শ্রেণির বিশ্রামাগারে ঢুকেই চোখ পড়ল টয়লেটের দিকে। সাবান বা টয়লেট টিস্যুর বালাই তো নেই-ই টয়লেটটিও অপরিষ্কার দেখা গেল। পারভীন আক্তার নামের যাত্রী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রথম শ্রেণির টয়লেটেই যদি এরকম নোংরা পরিবেশ হয় তাহলে বাকি টয়লেটগুলোর যে কী অবস্থা তা সহজেই বোঝা যাচ্ছে।

কথা হয় ট্রেনের টিটি ও গার্ডের সঙ্গে। তারা বলেন, প্রায় প্রতিটি ট্রেনেই যাত্রীরা গাদাগাদি করে দাঁড়াচ্ছেন, দিচ্ছেন হাঁচি-কাশি। গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন- গল্প করছেন। নৈশ ট্রেনগুলোর কেবিন যাত্রীদের বালিশ, চাদর ও কম্বলের পরিচ্ছন্নতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

কেননা এসব প্রয়োজনীয় কাপড়-চোপড় কমলাপুর রেল স্টেশনের ভিআইপি কক্ষের পাশের একটি কক্ষে স্তূপ করে রাখা হয়। পরে সেখান থেকেই ট্রেনে সরবরাহ করা হয়। স্টেশনের পুরো কক্ষটিই অপরিচ্ছন্ন। এক কর্মচারী জানান, এসব বালিশ-চাদর ও কম্বল ট্রেন্ডারের মাধ্যমে ধোয়া হয়। কোথায় হয় জানি না।

তবে ঢাকা রেলওয়ে বিভাগীয় কর্মকর্তা এএম সালাহ উদ্দিন বললেন, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে, স্টেশন পরিষ্কার- পরিচ্ছন্ন রাখতে। তবে যাত্রীরা নিয়ম-কানুন মানছেন না। নির্দেশনা এসেছে, দ্রুত সময়ের মধ্যেই স্টেশন ও ট্রেনগুলোতে সচেতনতামূলক প্রচারপত্র বিলি করা ছাড়াও পোস্টার-ব্যানার লাগানো হবে। সচেতনতামূলক ভিডিও ক্লিপ ছাড়া হবে।
সূত্র: যুগান্তর


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply