শ্রিংলার সাথে বিএনপির বৈঠক কেন হলো না?

|

মাহফুজ মিশু, নয়াদিল্লি থেকে:

করোনাভাইরাস প্রার্দুভাবের মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যোগ দিতে পারছেন না। আগে থেকেই এটা জানা ছিল। দেশটির পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা নিশ্চিত করলেন, ১৭ মার্চের আয়োজনে ভিডিও বার্তা পাঠাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ৫০ বছর উপলক্ষে ৫০টি ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ১০০টি, মোট দেড়শো অ্যাম্বুলেন্স ঢাকাকে উপহার দিতে যাচ্ছে দিল্লি।

শ্রিংলা মাত্র ক’বছর আগেই ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন। বাংলাদেশের অন্তত ৪৫টি জেলা ঘুরেছেন তিনি। বাংলাদেশের মানুষ, রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে ব্যাপক জানাশোনা তার। শ্রিংলার সাথে বাংলাদেশি সাংবাদিকদের মধ্যাহ্নভোজে ছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব বিক্রম দোরাসামি, মুখপাত্র রাভিশ কুমার, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ডেস্কের জয়েন্ট সেক্রেটারি স্মিতা পন্থসহ কয়েকজন কর্মকর্তা।

খাওয়ার ফাঁকেই চলছিল আড্ডা। জানার চেষ্টা করছিলাম, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব নিয়ে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাথে কি ভারত সরকার একটু বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে? অথবা বিএনপি’র সাথে ভারতের টানাপোড়েন কি আরো বেড়েছে? জনপ্রিয় আর প্রচলিত এসব ধারণা যাচাই বাছাইয়ের চেষ্টা চলতে থাকলো। বোঝার চেষ্টা করলাম, ২০১৩ সালে সংসদ নির্বাচনের আগ দিয়ে তৎকালীন ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব প্রয়াত সুজাতা সিংয়ের ঢাকা সফরে জাতীয় পার্টির প্রধান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সাথে বৈঠক কি দলটিকে নির্বাচনে যেতে (আংশিকভাবে) বাধ্য করেছিল?

ভারত সরকারের দাবি, সেই বৈঠকটি ছিল কেবলই সৌজন্য সাক্ষাৎ। যুক্তি, সেই বৈঠকের পরও ১৫৩ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থিতা ছিল না। এমনকি খোদ প্রয়াত এরশাদ নিজেও ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সেই নির্বাচনে অংশ নেননি। দিল্লির নীতিনির্ধাকরা বলছেন, স্বাভাবিকভাবেই অংশগ্রহণমূলক ভোট তারা চেয়েছিলেন। তবে বিশেষ কোনো দলকে ভোটে আনা বা বিরত রাখার প্রচেষ্টা তারা করেননি।

কথা প্রসংঙ্গেই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার সাম্প্রতিক ঢাকা সফরের বিষয়টি আসে। কয়েক ঘণ্টার সফরে ২-৩ মার্চ ঢাকা সফর করেন তিনি। মূলত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মুজিব বার্ষিকীর অনুষ্ঠান চূড়ান্ত করা ছিল সেই সফরের মুখ্য উদ্দেশ্য। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সেতু মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সাথে সাক্ষাৎ করেন তিনি। রাজনীতির মাঠে, টকশোতে, চায়ের আড্ডায় আলোচনা ছিল- বিএনপি’র সাথে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের কোনো বৈঠক হবে কিনা? যতদূর জানতাম, একটা বৈঠক চূড়ান্তও হয়েছিল। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর স্বাভাবিকভাবেই সেই বৈঠকে দলটির প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেয়ার কথা। পরবর্তীতে সেই বৈঠকটি হয়নি কিংবা বাতিল হয়। গুজব রটে, মিটিংয়ের শিডিউল চেয়েও পাননি বিএনপি নেতারা! অনেকেই ভাবেন, এবারো বিএনপিকে পাত্তা দিলো না ভারত। আসলে কী হয়েছিল?

দিল্লি এসে নিশ্চিত হলাম, বিএনপি বৈঠকের আগ্রহ দেখালে, সেটি চূড়ান্ত করে ভারত সরকার। কিন্তু কর্মসূচি বা অন্য যেকোনো কারণে হোক শেষ পর্যন্ত বৈঠকটি করতে পারেননি বিএনপি মহাসচিব। মির্জা ফখরুল নাকি বিএনপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির সদস্যদের শ্রিংলার সাথে বৈঠকে পাঠাতে চেয়েছিলেন। বিষয়টা মানতে রাজি হয়নি ভারত সরকার। কারণ, পররাষ্ট্র সচিব দলটির প্রধান অথবা মহাসচিবের সাথেই বসতে পারেন! প্রটোকল অনুযায়ী তাই হওয়ার কথা! দলের অন্য নেতারা চাইলে হাইকমিশনারের সাথে বৈঠক হতে পারে। তার মানে, ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সাথে বৈঠক চূড়ান্ত করেও সেখানে থাকেননি মির্জা ফখরুল! ভারতীয় থিংক ট্যাংকদের অনেকের ধারণা, লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পরামর্শেই বৈঠকটিতে উপস্থিত হননি মির্জা ফখরুল।

রেফারেন্স হিসেবে অনেকেই ২০১৩ সালে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির ঢাকা সফরে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার দেখা না করার ঘটনা স্মরণ করছেন। জামায়াতে ইসলামির ডাকা হরতালে সমর্থন দিয়ে , সেদিন হোটেল সোনারগাঁয়ে প্রণব বাবুর সাথে নিজ দেশে দেখা করেননি বেগম জিয়া। যদিও সেই ঘটনার ক’দিন আগে দিল্লি সফর করে প্রণব মুখার্জিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এসেছিলেন তিনি! অনেকের ধারণা, ভারতের সাথে সম্পর্ক রক্ষা বা উন্নয়নে একের পর এক কৌশলগত ভুল করে যাচ্ছে বিএনপি। আর এটি অব্যাহত থাকলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দলটি বন্ধুশূন্য হয়ে পড়ে কিনা, সেটি তাদের নীতিনির্ধারকদের ভাবার সময় হয়ে গেছে বোধহয়!

লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, যমুনা টেলিভিশন


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply