সর্বকালের সেরা তুর্কি ফুটবলার হাকান সুকুর এখন কেন যুক্তরাষ্ট্রে ট্যাক্সিচালক?

|

মনে আছে ২০০২ বিশ্বকাপের কথা? দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ। দর্শক তখনো ঠিকঠাকভাবে নিজেদের আসনে বসতে পারেননি। এর মধ্যেই মাত্র ১০.৮ সেকেন্ডেই হাকান সুকুরের গোল! লক্ষ্যভেদ করেই পাখির ডানা মেলার মতো হাত দুটো দুই পাশে ছড়িয়ে যেন উড়ে যেতে চাইলেন।

সবাইকে চমকে দিয়ে বিশ্বকাপ ইতিহাসের দ্রুততম গোলের মালিক বনে যাওয়া সেই ফুটবলারের নাম হাকান সুকুর। ওই মুহূর্তগুলোর কথা ফুটবলপ্রেমীদের ভুলার কথা নয়।

কিন্তু অবসরের পর এখন সুকুর কেমন আছেন কেউ জানেও না! বিবিসি জানাচ্ছে তার বর্তমান জীবনের দুঃখকষ্টের কথা।

রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন সুকুর। জীবন ধারণের জন্য ট্যাক্সি চালান আর বই বিক্রি করেন সেখানে।

সুকুর দাবি করলেন, তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান তার কাছ থেকে সব কেড়ে নিয়েছেন।

এক সময় ইউরোপের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার হিসেবে স্বীকৃত সুকুর জানিয়েছেন, তাকে রাষ্ট্রীয় শত্রু হিসেবে ঘোষণা করে তার সব সম্পদ কেড়ে নেয়া হয়েছে। ফলে জীবন বাঁচানোর তাগিদে তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছে। অথচ একসময় পুরো তুরস্কের রাস্তায় রাস্তায় তার ছবি আর পোস্টার শোভা পেতো। তাকে দেশটির জাতীয় বীর উপাধি দেওয়া হয়েছিল।

তুরস্ক, গ্যালাতাসারাই, ইন্টার মিলান ও ব্যাকবার্নের সাবেক এই সাবেক স্ট্রাইকারের জীবনের বাঁকগুলো বেশ চমকপ্রদ। ফুটবল ক্যারিয়ার শেষ করার পর রাজনীতিতে নেমেছিলেন। এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন এরদোগানেরই দল একে পার্টি থেকে। পাশাপাশি তিনি ছিলেন গুলেন ভক্ত।

কিন্তু এক সময় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয় ষড়যন্ত্রের। যদিও ২০১৬ সালে এরদোগানের বিরুদ্ধে হওয়া ব্যর্থ সামরিক ক্যু’র একজন সমালোচক ছিলেন সুকুর। যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত জীবন থেকেও এর সমালোচনা করেছেন তিনি।

তবে কোনো এক রহস্যজনক কারণে রাষ্ট্রীয় মিডিয়ায় তার নাম প্রকাশিত হয় দেশদ্রোহী ও ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে।

ক্লাব ক্যারিয়ারে ২৫০-এর বেশি গোল করেছিলেন সুকুর। আর দেশের জার্সিতে ১১২ ম্যাচে ৫১ গোল নিয়ে হয়েছিলেন তুর্কি ফুটবলপ্রেমীদের চোখের মণি।

গুলেনের সাথে এরদোগানের বিবাদ শুরুর পর ‘গুলেন আন্দোলন’র কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ক্রামার স্কুল বন্ধ করে দেয় এরদোগান সরকার। এর প্রতিবাদে সরব হন সুকুর। দল থেকেও পদত্যাগ করেন তিনি। মূলত সেখান থেকেই শুরু। এরপর টুইটারে এরদোগান সরকারের সমালোচনা করে আরও বিরাগভাজন হন। শুধু তাই না, বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া এক বক্তব্যে ‘আমি তুর্কি নই, আমি আলবেনিয়ান’ বলার পর নিজ দেশের মানুষের সমর্থনও হারিয়ে ফেলেন তিনি।

সরকারের সমালোচনার ফলে ২০১৬ সালের জুনে সুকুরের বিচার শুরু হয়। বিচারকার্যে নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও সরকার তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। তাকে দেশদ্রোহী তকমা দেওয়া হয়। এরপরই পরিবার নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান তিনি। তো কেমন আছেন এই কিংবদন্তি? এই প্রশ্নের জবাবেই ‘উবার চালক’ হিসেবে নিজের দুর্বিষহ জীবনের কথা জানান তিনি।

তুরস্কের সরকারের সমালোচনা করার পর তার ও তার পরিবারকে কতটা ঝড় সামলাতে হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে সুকুর বলেন, ‘২০১৩ সালে একেপি থেকে সরে যাওয়ার পর থেকেই ভয়াবহ আচরণের শুরু। আমার স্ত্রীর বুটিক শপে লোকে পাথর নিক্ষেপ শুরু করে, রাস্তায় আমার সন্তানদের উত্যক্ত করা হতো। আমার প্রতিটি বিবৃতির পর আমাকে হুমকি দেওয়া হতো। আমি যখন দেশ ছাড়লাম, তারা (তুরস্ক সরকার) আমার বাবাকে আটকে রাখে এবং আমার সব সম্পদ জব্দ করে।’

‘পৃথিবীতে আমার কিছুই নেই। এরদোগান আমার কাছ থেকে সব কেড়ে নিয়েছেন। আমার স্বাধীনতার অধিকার, আমার কথা বলার অধিকার এবং কাজ করার অধিকারও।’

সুকুরের বাবা এখনও গৃহবন্দি অবস্থায় আছেন। এর আগে ক্যান্সারের চিকিৎসার কারণে তাকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। তার মা নিজেও ক্যান্সারে আক্রান্ত। আক্ষেপ নিয়ে সুকুর বলেন, ‘এটা তাদের (বাবা-মা) জন্য খুব কঠিন সময়। আমার সঙ্গে যারাই সম্পর্কিত তাদের সবাইকে আর্থিক ঝামেলার মুখে পড়তে হচ্ছে।’

ট্যাক্সি ক্যাব চালানোর আগে ক্যালিফোর্নিয়ায় একটি ক্যাফে চালু করেছিলেন সুকুর। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই কিছু অপরিচিত লোক সেখানে হাজির হয়ে ‘ডোম্বরা মিউজিক’ বাজাতে শুরু করে। এই বিশেষ মিউজিককে একেপি পার্টি তুর্কিদের ঐতিহ্যবাহী ও সত্যিকারের মিউজিক বলে দাবি করে।

‘আমার কোনো অপরাধ কর্মের কোনো তালিকা কি তারা দেখাতে পারবে? না, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা আমাকে বিশ্বাসঘাতক এবং সন্ত্রাসী বলে ডাকে। আমি সরকারের শত্রু, কিন্তু দেশের নই। আমি আমার দেশ এবং দেশের পতাকাকে ভালোবাসি।’


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply