দুই হাত নেই, তার পরও সবকিছুতেই এগিয়ে লাদেন

|

কামাল হোসাইন,নেত্রকোনা

প্রবল ইচ্ছা শক্তি ও আত্মবিশ্বাসের জোরে শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে খেলাধূলা সহ পড়াশোনোয় এগিয়ে নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার নাগেরগাতি গ্রামের মাসুদুর রহমান লাদেন। জন্ম থেকেই দুটি হাত নেই তার। কিন্তু তারপরও সবকিছুতেই এগিয়ে চলেছে এই বিস্ময়বালক। দুটি হাত না থাকলেও ক্রিকেট কিংবা ফুটবলের মতো কঠিন খেলায়ও ভালো খেলছে সে। উপজেলার বিভিন্ন স্থানে টিমের পক্ষ হয়ে খেলে ইতিমধ্যেই সুনাম অর্জন করছে এই প্রতিবন্ধী কিশোর। তার স্বপ্ন প্রতিবন্ধি কোটায় কোনো ক্লাবে খেলে প্রতিষ্ঠিত খেলোয়ার হওয়ার। এবছর সে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করবে।

শারীরিক প্রতিবন্ধকতা দেখে জন্মের পর প্রতিবেশীরা বলে ছিল গলা টিপে শিশুটিকে মেরে ফেলতে। এরপর প্রতিবেশিরা পরার্মশ দেয় ঢাকা গিয়ে শিশুটিকে নিয়ে ভিক্ষা করতে। তারপর সত্তর হাজার টাকায় শিশুটিকে বিক্রি করে দিতে প্রস্তাব আসে। সব প্রস্তাবই প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। নিজ সন্তানের বর্ণণা দিতে গিয়ে ছয় সন্তানের মা এভাবেই বলছিলেন নেত্রকোণার দুর্গাপুর উপজেলার বিশেষ সন্তানের মাসুদুর রহমান লাদেনের মা হামেদা খাতুন। বর্তমানে ওই সন্তানের খেলাধূলাসহ পড়ালেখায় পারদর্শিতা দেখে মুগ্ধ মা বাবা। কিন্তু দারিদ্রতার কষাঘাতে শঙ্কিত লাদেনের মা বাবা।

মাসুদুর রহমান লাদেনের বাবা সাহেব আলী জানান, “প্রাইভেট পড়ানো ক্ষমতা না থাকলেও নিজে নিজেই পড়াশুনা করে লাদেন। এবার সে মেট্রিক পরীক্ষা দেবে। খেলাধূলার বেশি আগ্রহ তার। এরমধ্যে দুর্গাপুর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে টিমের পক্ষ হয়ে খেলেছে। তার ইচ্ছে বড় কোনো দলে প্রতিবন্ধি কোটায় খেলবে। আমার অর্থ সম্পদ ক্ষমতা কোনোটাই নাই। আমার ছেলেকে যদি কেউ অর্থনৈথিক সহযোগিতা করতো। তাহলে সে অনেক দূর যেতে পারতো।”

লাদেনের বন্ধুরা জানায়, হাত না থাকার বিষয়টি জীবনের কোনো কাজে লাদেনকে পিছিয়ে রাখতে পারেনি! অন্যান্য ছেলে-মেয়েদের মতোই সেও খেলাধূলাসহ সব প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। এছাড়া ব্যক্তিগত জীবনের দৈনন্দিন কাজগুলো সারছে কারো কোনো সহযোগিতা ছাড়াই! খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক কাজগুলোও একাই সারতে পারে। হাত না থাকার বিষয়টিকে লাদেন কোনো প্রতিবন্ধকতা বলেই মনে করে না। এজন্য তার মনে বিন্দুমাত্র দুঃখও নেই।

নবারুণ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অশোক কুমার ভাদুরী জানান, “জন্ম থেকেই দুটি হাত নেই। তবুও সবার সাথে পাল্লা দিয়ে ক্রিকেট, ফুটবলসহ বিভিন্ন ধরণের ঝুকিপূর্ণ খেলা। তার সাথে খেলায় সহপাঠিরা পারে না। পড়াশোনায়ও খুব ভালো সে। কিন্তু তার বাবা খুব দ্ররিদ্র মানুষ। তাকে পড়াশোনা করাতেই হিমশিম খাচ্ছে। সরকার বা সমাজের বিত্তবানরা এগিয়ে এলে এই ছেলে একদিন দেশের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবে।”

লাদেনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ফজলুল হক ফয়েজ জানান, অনেকেই হাত আছে কিন্তু কাজে লাগেনা। ভালো কোনো কাজ করেনা। কিন্তু লাদেনের দুটি হাত না থাকলেও সে সবার সাথে পাল্লা দিয়ে ক্রিকেট খেলছে,বিভিন্ন স্থানে গিয়ে ফুটবল খেলছে। তার শিক্ষকরা লাদেনকে বিষ্ময়কর বালক হিসেবেও আখ্যা দেন।

বিশেষ শিশু মাসুদুর রহমান লাদেন জানায়, “জন্ম থেকেই নিজের শারীরিক অক্ষমতাকে শক্তিতে রূপান্তর করে জীবনের পথে এগিয়ে যাচ্ছি আমি। হাত না থাকলেও লেখা পড়া কিংবা খেলাধূলায় কোনোটাতেই পিছিয়ে নাই। বড় হয়ে কোনো ফুটবল ক্লাবে প্রতিবন্ধী কোটায় খেলার স্বপ দেখি। মা-বাবা খুব গরিব। তারা কষ্ট করে আমাকে মানুষ করছেন। ছোটবেলা থেকে নিজের ইচ্ছাশক্তি, চেষ্টা ও সার্বক্ষণিক মায়ের সহযোগিতা পেয়ে হাত না থেকেও সব কাজ শেখা সম্ভব হয়েছে।

ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে লাদেন বলেন, পড়াশুনা শেষ করে একটি সরকারি চাকরি করতে চায় সে। প্রতিবেশিসহ লাদেনের পরিবারের দাবি সরকারী বেসরকারী সহযোগিতা পেলে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে এই বিশেষ শিশু লাদেন।

দুর্গাপুর সমাজসেবা কর্মকর্তা মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম জানান, খোঁজ পেয়ে তাকে প্রতিবন্ধী ভাতা দেয়া হচ্ছে জানিয়ে এই পরিবারকে সুদমুক্ত ব্যাংক ঋণসহ সব ধরণের সুবিধা দেয়া দেয়া হবে।

সরকারী বেসরকারী সহযোগিতা পেলে সমাজ ও দেশের মানুষকে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে দেখাতে চান জীবনের কোনো প্রতিবন্ধকতাই মানুষকে আটকে রাখতে পারেনা। তার এগিয়ে যাওয়ার পথে সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতা চাইলেন লাদেনের পরিবারের সদস্য।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply