ট্রেনচালক সংকট চরমে, ৩৭ ভাগ পদ শূন্য

|

রেলওয়েতে লোকোমোটিভ মাস্টার (ট্রেনচালক) সংকট চরমে উঠছে। স্বাধীনতার পর মাত্র ১৬০টি ট্রেন ছিল। বর্তমানে চলছে ৩৮০টি।

সংশ্লিষ্টদের হিসাবে, এসব ট্রেন চালাতে প্রয়োজন সাড়ে তিন হাজার চালক। কিন্তু বর্তমানে ট্রেন চালাতে পারছেন এমন চালক (এলএম) ও সহকারী চালক (এএলএম) মিলে রয়েছেন ৯৮৩ জন। ১৩৫ জন সাব-লোকোমোটিভ মাস্টার রয়েছেন, যারা ট্রেন চালান না, শান্টিং (ইঞ্জিন বা খালি কোচ স্থানান্তর) করেন।

ট্রেনের এ সংকট শিগগির মিটবে এমন সম্ভাবনাও নেই। সূত্রমতে, বর্তমান সরকার ৮ বছরে ৩৪৩ জন লোকোমাস্টার নিয়োগ দিয়েছে। ট্রেন চালানোর পর্যায়ে আসতে এদের ৪-১১ বছর সময় লাগবে। এ সময়ে অবসরে যাবে একটি অংশ। এ মুহূর্তে নতুন করে ব্যাপক সংখ্যক নিয়োগ দেয়া হলেও সংকট মিটতে এক যুগ লেগে যাবে।

সূত্রমতে, ট্রেন পরিচালনার যুক্ত পাঁচটি ক্যাটাগরির চালকদের জন্য মঞ্জুরি করা পদের সংখ্যা ১ হাজার ৭৫৭। এসব পদ মঞ্জুরি করা হয়েছিল স্বাধীনতার পর ১৬০টি ট্রেন চালাতে।

এর মধ্যেও খালি রয়েছে ৬৩৯টি, যা মঞ্জুরি করা পদের প্রায় ৩৭ শতাংশ। এর মধ্যে চালকের (গ্রেড-১) ২৭৯টি পদের মধ্যে ৩৮ পদ শূন্য। আর চালকের (গ্রেড-২) ৪৮৩ পদের মধ্যে শূন্য ৩০২টি। অর্থাৎ মূল রেলপথে ট্রেনচালকের মঞ্জুরি করা ৭৬২ পদের মধ্যে ৩৪০টিই শূন্য। সাব-লোকোমাস্টার পদে ২৭৮টি পদের মধ্যে খালি ১৪৩টি।

চালকদের চাকরি শুরু করতে হয় অ্যাসিস্ট্যান্ট লোকোমাস্টার গ্রেড-২ পদে যোগ দেয়ার মাধ্যমে। রেলে মঞ্জুরি করা এই পদ ৪৮৩টি। শূন্য রয়েছে ১৫৪টি।

চালক সংকটের মুখে ২০১২ সালে অবসরে যাওয়া ১১৬ লোকোমাস্টারকে চুক্তিতে নিয়োগ দেয় রেল। কিন্তু প্রবীণ এসব মানুষকে নিয়োগ দেয়া নিয়ে ভিন্ন মত রয়েছে রেলেই। বয়সজনিত কারণে এদের একটি অংশ শারীরিকভাবে সবল এবং তীক্ষ্ণ দৃষ্টিসম্পন্ন নয়। তাদের নিয়োগ সংকট দূরীকরণে সমাধান হিসেবেও দেখেন না সংশ্লিষ্টরা।

রেলের যান্ত্রিক প্রকৌশলীদের মতে, গড় বয়স ৪০ বছর হলে চালকরা শারীরিকভাবে তুলনামূলক সবল থাকেন। এ বয়সের দক্ষ লোকোমাস্টার বর্তমানে নেই বললেই চলে। বর্তমানে ট্রেনচালকদের গড় বয়স ৫০-এর উপরে।

এ অবস্থায় চালকরা অতিরিক্ত সময় দিয়ে দিন-রাত ট্রেন চালাচ্ছেন। নেই প্রয়োজনীয় বিশ্রাম, নেই সাপ্তাহিক ছুটি। অসুস্থ থাকলেও চালাতে হচ্ছে ট্রেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব কারণে প্রায়ই ছোটখাটো ভুল হয়ে থাকে তাদের। আর তা থেকে ঘটছে বড় দুর্ঘটনাও।

রেলেরই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ৭২ শতাংশ দুর্ঘটনাই ঘটেছে মানুষের ভুলের কারণে। রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী জানান, একে তো চালক সংকট, আবার যারা রয়েছেন- তারা বিশ্রাম নিতে পারছে না। বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত সময় নিয়ে কাজ করছেন। তারা যেসব স্থানে বিশ্রাম নেবেন- সেসব স্থান একেবারেই বিশ্রামের অনুপযোগী।

তারা পরিবার-সামাজিক বন্ধনেও সম্পৃক্ত হতে পারছেন না। তিনি বলেন, চালকের শূন্যস্থানগুলো পূরণ না হলে ঝুঁকি দিন দিন বাড়তেই থাকবে। রেলওয়ে জনপ্রশাসন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত রেলে কোনো নিয়োগ হয়নি।

১৯৯৯ সাল থেকে নিয়োগ শুরু হলেও ট্রেন পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত পদে নিয়োগ হয়নি। বর্তমান সরকার ২০১২ সালে ৫৩ জন, ২০১৪ সালে ১৭৭ জন, ২০১৩ সালে ৭০ জন এবং ২০১৭ সালে ৪৩ জন লোকোমাস্টার নিয়োগ দেয়। এ বছরের ১৩ মার্চ ৫৭ জন লোকোমাস্টার নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়।

এখনও নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়নি। বর্তমান সরকারের আমলে ১৪ হাজারের বেশি লোকবল নিয়োগ হলেও ট্রেনচালকের সংখ্যা মাত্র ৩৪৩ জন।

রেলের এক কর্মকর্তা জানান, রেলে ব্যাপক হারে উন্নয়ন প্রকল্প হচ্ছে। লাইন বাড়ছে, বাড়ছে ট্রেন। নিয়োগে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়ার কথা ছিল চালক, গার্র্ড ও স্টেশন মাস্টারের ক্ষেত্রে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে তা করা হয়নি। একটি চক্র এসব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে আগ্রহ দেখিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে দেড় শতাধিক ব্যক্তি এসব পদে চুক্তিভিত্তিক কাজ করছে।

পূর্বাঞ্চল রেলওয়ে যান্ত্রিক প্রকৌশলী বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে অবৈধ আর্থিক লেনদেন হয়ে থাকে। একজন চালককে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ দেয়ার নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। অবসরকাল সময়ে যারা যত বেতন পেতেন সেই পরিমাণ বেতন দিয়েই তাদের নিয়োগ দেয়া হয়।

তাদের স্বাস্থ্য, দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি যথাযথ থাকলেই শুধু নিয়োগ দেয়ার কথা, কিন্তু সেটি ঠিকমতো মানা হয় না। রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মিয়াজাহান জানান, ট্রেন পরিচালনা করতে প্রায়ই হিমশিম খেতে হয়। বর্তমান সরকার রেলে যেভাবে উন্নয়ন করছে, নতুন নতুন ট্রেন উদ্বোধন করছে- তাতে কয়েক বছরের মধ্যে ট্রেনের সংখ্যা দাঁড়াবে ৫শ’। তখন আরও চালক লাগবে।

তিনি বলেন, রেলে বর্তমানে লোকবল রয়েছে ২৫ হাজার ৫৭০ জন। সুষ্ঠুভাবে ট্রেন পরিচালনার স্বার্থে আমরা নতুন করে ৫০ হাজার ২৭৫ জনবলের প্রস্তাব জনপ্রশাসনে পাঠিয়েছি।

রেলওয়ের মহাপরিচালক শামছুজ্জামান জানান, লোকবল সংকট থাকবে না, নিয়োগ হচ্ছে। ট্রেনচালক নিয়োগে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। দক্ষ চালক তৈরি করতে দেশ-বিদেশে তাদের পাঠানো হবে।

রেলপথ সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন জানান, অবসরে যাওয়া চালকদেরই চুক্তিতে নিয়োগ দিতে হচ্ছে।

বয়স্ক এসব চালক দিয়ে ট্রেন চালানো ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ। মাঠপর্যায়ে থেকে চুক্তি ভিত্তিতে চালক নিয়োগের প্রস্তাব এলেও আমরা তা নিয়ে ভাবছি না। আমরা চাচ্ছি চুক্তিতে নয়, নিয়োগ পাওয়া চালকদের কী করে দ্রুত দক্ষ করা যায়। তিনি বলেন, পর্যাপ্ত চালক নিয়োগের জন্য প্রস্তাব আমরা দিচ্ছি।

সূত্র: যুগান্তর


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply