মেয়াদোত্তীর্ণ ৭৭ শতাংশ রেল ইঞ্জিন

|

রেলে দিন দিন বাড়ছে দুর্ঘটনা। ঝরছে প্রাণ, হচ্ছে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। সেইসঙ্গে সময়সূচির (সিডিউল) বিপর্র্যয় রেলে নিত্য ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

চলতে চলতে হঠাৎ থেমে যাচ্ছে ট্রেন। এতে একদিকে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন যাত্রীরা, অন্যদিকে ট্রেন পরিচালনায় হিমশিম খেতে হচ্ছে রেলকে, বঞ্চিত হচ্ছে কাঙ্ক্ষিত আয় থেকে।
এর মূল কারণ রেলের লোকোমোটিভ (ইঞ্জিন) সংকট। সূত্র বলছে, বাংলাদেশে রেলওয়েতে এখন ২৬২টি লোকোমোটিভ রয়েছে, এর ২০৬টিই অর্থাৎ ৭৭ শতাংশেরই আয়ুষ্কাল শেষ। অথচ ‘বুড়ো’ এসব লোকোমোটিভ দিয়েই দিনের পর দিন চালানো হচ্ছে ট্রেন।

রংপুর কাউনিয়ায় বৃহস্পতিবার মেইল ট্রেন ‘সেভেন আপ’ দুর্ঘটনায় ১ কলেজছাত্র নিহত হন, আহত হন ৩০ জন। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী মৃণাল কান্তি বণিক শুক্রবার সন্ধ্যায় বলেন, দুর্ঘটনাটি ঘটেছে ইঞ্জিনের ব্রেক ফেল হওয়ায়। দাঁড়িয়ে থাকা ৯ বগির রেকের সঙ্গে যুক্ত হতে গিয়ে ইঞ্জিন সজোরে ধাক্কা দেয় তাতে।

এতে দুটি বগি দুমড়ে-মুচড়ে একটি-আরেকটির মধ্যে ঢুকে যায়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইঞ্জিনও। তিনি বলেন, ওই ইঞ্জিনটির আয়ুষ্কাল বহু আগেই শেষ হয়েছে।

প্রকৌশল বিভাগ সূত্র জানায়, চলতি বছরের ২৩ জুন ঢাকা-সিলেট পথে কুলাউড়ায় উপবন এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় ৬ জন নিহত হন, আহত হন অর্ধশত যাত্রী।

তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে, ট্রেনটির ইঞ্জিন ও বগির আয়ুষ্কাল ৪০ বছর আগে শেষ হয়েছে। সূত্রমতে, ২০১০ সালের ৯ ডিসেম্বর নরসিংদী স্টেশনে ট্রেন দুর্ঘটনায় ১১ জন নিহত হন, আহত হন ৪০ জন।

গত বছরের ১৫ এপ্রিল জামালপুর-টঙ্গী সেকশনে লোকাল ট্রেন দুর্ঘটনায় তিনজন নিহত, ১৫ যাত্রী আহত হন। ২০১৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর কারওয়ান বাজারে দুর্ঘটনায় ৫ জন মারা যান।
২৮ ডিসেম্বর কমলাপুর ইয়ার্ড এলাকায় ৬ জন মারা যান, আহত হন ২৩ জন। ২০০৮ সালে আখাউড়ার আজমপুর রেলওয়ে স্টেশনে দুর্ঘটনায় ২৪ যাত্রী নিহত হন, আহত হন ৪০ জন। এসব ট্রেনের একটি লোকোমোটিভেরও আয়ুষ্কাল ছিল না। বুড়ো ইঞ্জিন ও বগি এসব দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ।

এক প্রকৌশলী জানান, পুরনো ইঞ্জিন জোড়াতালি দিয়ে চালু রাখা হয়েছে। ফলে চলন্ত ট্রেন হঠাৎ থেমে যাচ্ছে। ফলে শত চেষ্টায়ও সিডিউল ঠিক রাখা যাচ্ছে না। শুধু পূর্বাঞ্চল রেলওয়েতে গেল বছর ১৫৫ বার ইঞ্জিন ফেল (হঠাৎ বন্ধ) হয়েছে।

তিনি জানান, রেলে বর্তমানে ২৬৮টি (৩১ জুলাই ২০১৯ পর্যন্ত) লোকোমোটিভ রয়েছে, এর ২০৬টির আয়ুষ্কাল শেষ। ৩৫৮টি ট্রেনে ১৬২১টি কোচ রয়েছে, যার ৮০ শতাংশই মেয়াদোত্তীর্ণ। এসব ইঞ্জিন-বগি বাতিল করে দেয়ার নিয়ম, কিন্তু বহু টাকা খরচ করে মেরামত করে কোনোমতে চালানো হচ্ছে।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান যান্ত্রিক প্রকৌশলী মৃণাল কান্তি বণিক জানান, পশ্চিমাঞ্চলে ১১৬টি ইঞ্জিনের মধ্যে মাত্র ৩৯টির আয়ুষ্কাল রয়েছে। ৭১০টি বগির মধ্যে ৭০ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ। ২০ বছরের আয়ুষ্কাল শেষ হওয়ার পর এগুলো আরও ৫০-৫৫ বছর ধরে চালানো হচ্ছে। বিশ্বের কোথাও এসব ইঞ্জিন-বগির যন্ত্রাংশ পাওয়া যায় না।

আমরা স্থানীয়ভাবে তৈরি করে ট্রেনগুলো চালাচ্ছি। বিশ্বের কোথাও এভাবে ট্রেন চালানোর উদাহরণ নেই। সূত্রমতে, ব্রিটিশ আমলে ট্রেন চলত বাষ্পীয় ইঞ্জিনে। ১৯৫৩ সালে রেলে প্রথম ডিজেল চালিত লোকোমোটিভ যুক্ত হয়। এমইজি-১১ মডেলের আমেরিকান ইঞ্জিন রেলওয়ের বহরে যুক্ত হয় ১৯৫৩ সালের ২৭ ডিসেম্বর। সেসব ইঞ্জিনের ৮টি এখনও ব্যবহার করা হচ্ছে।

সূত্রমতে, গত ৫ বছরে রেল খাতে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ হয়েছে। ১০ বছরে এ অঙ্ক ৬৪ হাজার কোটি টাকার বেশি।

সিংহভাগ অর্থই ব্যয় করা হয়েছে পুরনো ভবন ভেঙে নতুন স্টাইলের ভবন নির্মাণ ও স্টেশনগুলো রি-মডেলিং করার কাজে এবং রেলপথ মেরামত ও পুনর্নির্মাণে।

তবে ইঞ্জিন ও বগির সমস্যায় রেলই যে অচল হয়ে পড়ছে- সেদিকে ততটা চোখ পড়েনি সংশ্লিষ্টদের। আবার যেভাবে রেলপথের উন্নয়ন প্রয়োজন, করা হয়নি তেমনভাবেও। সূত্র জানায়, ১০ বছরে ৪৬টি ইঞ্জিন রেলের বহরে যুক্ত হয়েছে, তবে এগুলো এসেছে এর আগে বিভিন্ন সময়ে নেয়া উদ্যোগের কারণে।

রোলিং স্টক সূত্র জানায়, ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে হলে অন্তত ১৫০টি লোকোমোটিভ ও শতাধিক যাত্রীবাহী বগি এখনই প্রয়োজন। কিন্তু ৫-৭ বছরের মধ্যে নতুন লোকোমোটিভ যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। ফলে এ সময়ে ঝুঁকি নিয়েই চলবে রেল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আরএস) সৈয়দ ফারুক আহমদ বলেন, আমরা চেষ্টা করছি কীভাবে দ্রুত ইঞ্জিন ও বগি কেনা যায়। বর্তমান সরকার রেলে ব্যাপক উন্নয়ন করছে।

আশা করছি ৪ বছরের মধ্যে ৩০টি লোকোমোটিভ কেনা সম্ভব হবে। তবে তিনি স্বীকার করেন, ২০১২ সালে ৭০টি লোকোমোটিভ কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। কিন্তু নানা জটিলতায় এখন পর্যন্ত ওই উদ্যোগের একটি ইঞ্জিনও আনা সম্ভব হয়নি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেন, বর্তমান সরকার রেলে অনেক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে।

কিন্তু সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতা না থাকা, প্রকল্পে দুর্নীতি আর অনিয়মের কারণে কোনো প্রকল্পই যথাসময়ে শেষ হচ্ছে না। অন্যদিকে রেলপথের প্রকৃত (যেখানে যা প্রয়োজন) উন্নয়ন করা হচ্ছে না, যে পরিমাণ ইঞ্জিন-বগি কেনা প্রয়োজন তাও কেনা হচ্ছে না বা তৈরি করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না।

আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে যাওয়া ইঞ্জিন-বগি দিয়ে ট্রেন চালিয়ে বাহবা পেতে চাচ্ছে সংশ্লিষ্টরা। এটি চরম অন্যায়, অপরাধ। সাধারণ যাত্রীদের সেবা নিশ্চিত না করে ট্রেনকে মৃত্যুফাঁদ বানানো হচ্ছে। উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে ট্রেনের ইঞ্জিন-বগি সমানতালে কেন কেনা হল না- এর অনুসন্ধান জরুরি।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply