হার্ট অ্যাটাকে রিং পরানোই শেষ কথা নয়

|

অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান:

মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোর মধ্যে হার্ট বা হৃদযন্ত্র একটি। হৃদযন্ত্রের কাজ হলো – শরীরের বিভিন্ন অংশে যথাযথভাবে রক্ত সরবরাহ করা। রক্ত শরীরকে অক্সিজেন এবং পুষ্টি সরবরাহ করে, পাশাপাশি বিপাকীয় বর্জ্য অপসারণে সহায়তা করে। বিভিন্ন কারণে এ যন্ত্রটি রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। হৃদযন্ত্রের করোনারি ধমনিতে ব্লক, হৃদযন্ত্রের ভাল্ব নষ্ট, হৃদযন্ত্রের পর্দায় পানি জমা, আকার বড় হওয়া ও দুর্বল হওয়া ইত্যাদি রোগ অন্যতম। এসব রোগ মূলত করোনারি ধমনিতে চর্বির আধিক্য, ডায়াবেটিস, হরমোন, টিবি, ক্যানসার, টিউমার, বাতজ্বর, ধুমপান, শরীরের ওজন বৃদ্ধি, উচ্চ রক্তচাপ, কায়িক পরিশ্রম একদম না করা, নারীদের জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি গ্রহণ, অ্যালকোহল পান ও অ্যান্টিক্যানসার ড্রাগ গ্রহণ এমনকি জেনেটিক্সের মাধ্যমে আমাদের পিতামাতার কাছ থেকে চলে আসতে পারে।

কিন্তু এ রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়। আবার আক্রান্ত হলে তা চিকিৎসা সেবার মাধ্যমে সুস্থ করে জীবনযাপন করা যায়। হৃদরোগের ঝুঁকি সমূহের মধ্যে কিছু বিষয় যা আমরা অভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।

১. ধূমপান ও তামাক ব্যবহার করবেন না- শুধুমাত্র ধূমপান এবং তামাক জাতীয় দ্রব্য ত্যাগ করলে, আপনি পঞ্চাশ শতাংশ হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারেন।

২. চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত উচ্চ-রক্তচাপের ওষুধ বন্ধ করবেন না- প্রত্যেকেরই রক্তচাপ নিয়মিত পরীক্ষা করা উচিত। কায়িক পরিশ্রম বাড়িয়ে, স্বাস্থ্যকর খাবারের মাধ্যমে এবং স্বাস্থ্যকর ওজন ধরে রাখার মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপ হ্রাস করা যায়।

৩. ডায়াবেটিসে রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রনে রাখুন – অতিরিক্ত ওজন এবং শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা টাইপ ২ ডায়াবেটিসের কারণ হতে পারে। যেভাবেই হোক ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখতে হবে নতুবা হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনি রোগ অথবা পায়ের রক্তনালির সমস্যা হতে পারে। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের ওষুধ সেবনের পাশাপাশি নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা উচিত।

৪. প্রতিদিন ৩০ মিনিট ব্যায়াম করুন – ছন্দবদ্ধ জীবন যাপনের মাধ্যমে উচ্চ-রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ নিয়ন্ত্রনে রাখা সম্ভব। নিয়মিত ব্যায়াম রক্তে শর্করার মাত্রা হ্রাস করে, ক্যালোরি পোড়ায় এবং কোলেস্টেরলের জটিলতা রোধ করতে সহায়তা করে।

৫. কোলেস্টেরল কখনই ঘুমায় না – কোলেস্টেরল সর্বদা আপনার রক্তনালীগুলির ক্ষতি করার চেষ্টা করে। রক্তে খুব বেশি কোলেস্টেরল হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। প্রাপ্তবয়স্কদের সাধারণত ৪০ বছর বয়সে প্রতি বছর কমপক্ষে একবারে তাদের কোলেস্টেরল পরিমাপ করা উচিত।

৬. শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখুন – পরিমিত স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য তালিকা এবং স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখতে সক্রিয় হন। অভিভাবকদের উচিত ছোট বেলা থেকেই সন্তানদের এ ব্যাপারে সহায়তা করা। এবং ফাস্ট ফুড পরিহার করে খেলাধুলার অভ্যাস করার অনুপ্রেরণা দেয়া।

যদি কারো পরিশ্রম করলে বুকে চাপ চাপ লাগে, সিঁড়ি ব্যবহার করলে দম বন্ধ হয়ে আসে, তা হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার। এ জন্য হৃদযন্ত্রের রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা রয়েছে। কারো হৃদযন্ত্রের রোগ আছে কিনা, জানতে উপসর্গ অনুযায়ী ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাফি এবং ইটিটি করা যেতে পারে। যদি পরীক্ষায় পজিটিভ হয়, তা হলে এনজিওগ্রাম করা দরকার। কারণ এনজিওগ্রামের মাধ্যমে জানা যাবে হৃদরোগের প্রকৃত অবস্থা। সেই অবস্থা দেখেই ব্যবস্থা নিতে হবে। কারো হার্ট অ্যাটাক হলে তার হৃদযন্ত্রে রিং পরাতে হয় অথবা বাইপাস করতে হয়। বাজরে যেসব রিং বিক্রি হয়, সেগুলোর মধ্যে মানের দিক থেকে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে।

আবার যারা রিং পরান, সেই চিকিৎসকদের মধ্যেও যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। সবার পক্ষে রিং পরানো সম্ভব হয় না। আবার রিং পরালেও অনেক ক্ষেত্রে ভালো হয় না। রিং পরানোর ক্ষেত্রে চিকিৎসকের স্কিলনেস থাকা জরুরি। তবে রিং পরানোই শেষ কথা নয়। হৃদযন্ত্রের যে স্থানে ব্লক, চিকিৎসক সেখানে রিং পরিয়ে রক্ত চলাচলের পথ করে দেন। কিন্তু রোগীর তা বুঝতে না পারার কারণে অনেক সময় রিং বন্ধ হয়ে যেতে পারে। রিং পরানোর পর চিকিৎসক রোগীকে কিছু ওষুধ দিয়ে থাকেন রক্ত পাতলা রাখার জন্য।

কিন্তু রিং পরানো ব্যক্তি যদি সেই ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেন, তা হলে রক্ত জমাট বেঁধে রিং দিয়ে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ কারণে রোগীর হৃদযন্ত্র পুনরায় রিং পরানোর প্রয়োজন পড়ে। তবে হার্ট অ্যাটাকের আগেই রিং পরানো সম্ভব হলে সবচেয়ে সুফল পাওয়া যায়। হার্টের সমস্যার ক্ষেত্রে রোগীদের মধ্যে কিছু উপসর্গ অনুভূত হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশের মানুষ রোগী হয়ে আসেন রোগ তীব্রমাত্রায় পৌঁছার পর অর্থাৎ শেষ পর্যায়ে। তখন রোগীকে যথাযত চিকিৎসা দেওয়ার আর অবস্থা থাকে না এ জন্য হৃদরোগের উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

লেখক: হৃদরোগ বিষেশজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply