কী ঘটছে শোভন-রাব্বানীর ভাগ্যে?

|

ফররুখ মাহমুদ:

ধারাবাহিক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে বেকায়দায় আছেন ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক এবং ডাকসুর জিএস গোলাম রাব্বানী। আগামীকাল তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। গুঞ্জন রয়েছে, ভেঙে দেয়া হতে পারে বর্তমান কমিটিও।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতীতে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে এমন পরিস্থিতে পড়তে হয়নি। প্রধানমন্ত্রী ক্ষোভ প্রকাশের পর অনেকটাই একঘরে হয়ে গেছেন তারা। ছাত্রলীগের অনেক নেতাই এড়িয়ে চলছেন তাদের। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে মতামত দিচ্ছেন। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন আওয়ামী লীগের অনেক সিনিয়র নেতারাও। গত কয়েকদিনে অন্তত দশজন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের সাথে দেখা করেছেন ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু কেউই তাদের আশ্বস্ত করতে পারেননি। সবাই বলেছেন, এটা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দেখছেন।

বারবার সাক্ষাৎ চেয়েও ব্যর্থ হয়ে প্রধানমন্ত্রী বরাবর চিঠি লিখেছেন গোলাম রাব্বানী। চিঠিতে তিনি ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

২০১৮ সালের ৩১ জুলাই রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভনকে সভাপতি ও গোলাম রাব্বানীকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে সংগঠনে চলে আসা বলয় (কথিত সিন্ডিকেট) ভেঙে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এ কমিটি করা হয়। ফলে জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের কোনো নেতার হস্তক্ষেপ ছিলো না কমিটিতে। কিন্তু সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারেননি শোভন-রাব্বানী। জড়িয়ে পড়েছিলেন নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে। যে কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্বেই ছাত্রলীগের জন্য নতুন নেতৃত্ব খোঁজার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী।

পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে শোভন-রাব্বানীর পেরিয়ে যায় এক বছর। নিজেদের অনুসারীদের কমিটিতে স্থান দিতে গিয়ে বাদ দেন অনেক ত্যাগী নেতাকর্মীদের। পরে পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা আন্দোলন শুরু করে। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের আশ্বাসে অনশন কর্মসূচি স্থগিত করে তারা। এর মধ্যে মধুর ক্যান্টিনে পদবঞ্চিতদের মারধরের ঘটনা বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। এছাড়া ১১১টি সাংগঠনিক ইউনিটের মধ্যে তারা মাত্র দুইটিতে কমিটি দিতে পেরেছিলেন।

এর পাশাপাশি চাঁদাবাজি, অনুষ্ঠানে সময়মতো উপস্থিত না হওয়া, নেতা বানানোর বিনিময়ে আর্থিক সুবিধা নেয়া, সাংবাদিকদের ফোন রিসিভ না করা, মাদকসেবন, দুপুরের আগে ঘুম থেকে না ওঠা, সংগঠনের ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণসহ নানা অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নের্তৃত্বের বিরুদ্ধে।

সম্প্রতি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম রাকিব ফাঁস হওয়া এক অডিও বার্তায় স্বীকার করেছেন ৪০ লাখ টাকার বিনিময়ে তিনি নেতা হয়েছেন। অডিওতে তিনি বলেন, কমিটি ভাঙা এবং নেতা হতে তার এ টাকা খরচ হয়। গোলাম রাব্বানীর অনুসারী এ নেতা দাবি করেন, আঞ্চলিক কমিটির দায়িত্ব তাকে রাব্বানী দিয়েছেন। অডিওতে শোনা যায়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটিতে একজনকে নেতা বানাতে তিনি দেন-দরবার করছিলেন। শুক্রবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জয়নুল আবেদীন রাসেল কেন্দ্রীয় নেতাদের আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি উল্লেখ করে স্ট্যাটাস দেন। তিনি লেখেন, কমিটি স্থগিতের পর ঠিক করে দেয়ার জন্য কত টাকা চেয়েছিলেন মনে আছে?

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় উন্নয়নের জন্য ১ হাজার ৪৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকার যে সরকারি বরাদ্দ পায় সেখান থেকে ৪ অথবা ৬ পার্সেন্ট কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগকে দেয়ার জন্য ভিসিকে চাপ দেন শোভন-রাব্বানী। ৮ আগস্ট রাতে ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের সাথে দেখা করে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন নেতারা। এসব অভিযোগ করেছেন ভিসি নিজেই। ভিসি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে পুরো ঘটনা বলার পর তিনি বলেন, ‘ওরা তোমাকেও কষ্ট দিলো।’

এছাড়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দীর্ঘক্ষণ বসিয়ে রাখেন ছাত্রলীগের দুই নেতা। সকালের অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যথাসময়ে উপস্থিত হলেও ছাত্রলীগের শীর্ষ দুই নেতা উপস্থিত হন দুপুরে। ওই সম্মেলনে প্রচণ্ড গরমে স্ট্রোক করে ছাত্রলীগের এক কর্মীর মৃত্যু হয়। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপু মনি এবং আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা তোফায়েল আহমেদের সাথেও একই ধরনের আচরণ করেন তারা। ফলে নেতারা ক্ষুব্ধ হয়ে সভানেত্রীর কাছে শোভন-রাব্বানীর নামে বিচার দেন বলে জানা যায়।

সূত্র জানায়, ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে মাদকসেবনের অভিযোগও প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা পড়ে। এই ধরনের একটি ঘটনায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলীয় সিদ্ধান্তে তালা লাগিয়ে দেয়া হয়।

গত ১০ সেপ্টেম্বর দুপুরে মধুর ক্যান্টিনের সামনে সভাপতির গাড়িতে বসাকে কেন্দ্র করে দুই সহসভাপতি বিদ্যুত ও জহির হাতাহাতিতে লিপ্ত হন। এতে বিদ্যুতের মাথা ফেটে যায়। এ ঘটনা মোবাইলে ধারণ করায় এক সাংবাদিককে জোর করে ছাত্রলীগ সভাপতির গাড়িতে তুলে নিয়ে ভিডিওটি মুছে ফেলতে বাধ্য করা হয়। এঘটনায়ও বেশ সমালোচনার মুখে পড়ে ছাত্রলীগ। পরবর্তীতে সাংবাদিকদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন সংগঠনটির সভাপতি।

এসব অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন। তিনি বলেন, সংগঠনের নেতৃত্ব দেয়া কালে আমরা ভুল ত্রুটি করে থাকতে পারি। সেটি শুধরে নিচ্ছি। আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি করি, বঙ্গবন্ধু কন্যার রাজনীতি করি। সকল বিষয়ে তার সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনাই আমরা মেনে চলবো।

ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী যমুনা নিউজকে বলেন, সিন্ডিকেট ভেঙে আপা আমাদের কমিটি গঠন করেছিলেন। আর এ কারণেই সিন্ডিকেটের লোকজন শুরু থেকেই কমিটির পেছনে লেগেছে। তারাই নানা কথা বলে আপার কান ভারি করার চেষ্টা করছে। আমি বিশ্বাস করি, আপা আমাদের কথা শুনবেন। প্রত্যেকটা অভিযোগের পেছনে ব্যাখ্যা আছে। উনি ব্যাখ্যাগুলো শুনলে আমাদের ক্ষমা করে দেবেন বলে আশা রাখি। কমিটি ভেঙে দেয়ার গুঞ্জনের বিষয়ে তিনি বলেন, ছাত্রলীগটা আপার। আপা যা চাইবেন তাই হবে।

যমুনা অনলাইন: এফএম/টিএফ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply