বাড়ছে রেললাইনে মৃত্যু, বেশিরভাগের মিলে না পরিচয়

|

রেললাইনে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। এর মধ্যে বেশির ভাগই আত্মহত্যা। এছাড়া রয়েছে অসচেতনতা বা অসুস্থতাজনিত কারণে মৃত্যু। অপরাধীরাও হত্যাকাণ্ড আড়াল করতে রেললাইনে লাশ ফেলে যায়।

উদ্ধার হওয়া এসব লাশের বেশির ভাগেরই পরিচয় পাওয়া যায় না। এর প্রধান কারণ- ট্রেনে কাটা পড়ে লাশ বিকৃত হয়ে যায়। তাছাড়া লাশ ময়নাতদন্তে পাঠানো হলেও রিপোর্ট পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়।

রেলওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সারা দেশে রেললাইন থেকে ৫ হাজার ৪৫০ জনের লাশ উদ্ধার করে রেলওয়ে পুলিশ। এদের মধ্যে মাত্র ২১ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে।

২০১৭ সালে রেলে কাটা পড়ে দুই হাজার ১০০ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৮ সালে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ২ হাজার ৩০০ জনে। একই বছর শুধু ঢাকা রেলওয়ে বিভাগে ১ হাজার ২ জনের লাশ উদ্ধার করে ঢাকা রেলওয়ে পুলিশ। এর মধ্যে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও রয়েছে। ওই বছর ৩টি হত্যা মামলা হয় ঢাকা রেলওয়ে থানায়।

মামলায় ওঠে আসে, যাত্রীদের ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করছে সংঘবদ্ধ অপরাধীরা। অন্যস্থানে খুন করে ঘটনা ভিন্ন খাতে নেয়ার জন্য দুর্বৃত্তরা লাশ ফেলে যাচ্ছে রেললাইনে। ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত হত্যা মামলা হয়েছে ২১টি।

জানা গেছে, রেললাইনে পাওয়া লাশের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশই আত্মহত্যা। ১০ শতাংশ অসুস্থতাজনিত কারণে মৃত্যু। আর ৩০ শতাংশ মৃত্যু ঘটছে কানে মোবাইল ফোন বা হেডফোন লাগিয়ে অসচেতনভাবে চলাচলের কারণে। বাকি ১০ শতাংশ হত্যা ও অন্যান্য মৃত্যু।

প্রায় ৩ হাজার কিলোমিটার রেলপথের ৯৮ শতাংশ এলাকাই রাতে অন্ধকারে ঢাকা থাকে। অনেক এলাকা থাকে নির্জন। অপরাধীরা লাশ গুম করতে এসব অন্ধকার ও নির্জন এলাকা বেছে নেয়। এ কারণে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন অপরাধ কমাতে হলে লাইন ঘেঁষে সিসি ক্যামেরা স্থাপন জরুরি।

এ বিষয়ে রেলওয়ে রেঞ্জের অ্যাডিশনাল আইজিপি মো. মহসিন হোসেন বলেন, রেলপথে ভ্রমণ সবচেয়ে নিরাপদ। এ পথে মৃত্যু খুবই দুঃখজনক। নানা কারণে এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। যার মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ মৃত্যু হচ্ছে আত্মহত্যা।

কখনও কখনও হত্যাকাণ্ডকে ভিন্ন খাতে নিতে লাশ এনে লাইনের ওপর ফেলছে অপরাধীরা। পুরো রেলপথ পাহারা দেয়া রেলওয়ে পুলিশের পক্ষে কখনও সম্ভব নয়। তাছাড়া পুরো রেলপথই উন্মুক্ত, বেড়া কিংবা দেয়াল নেই।

তিনি বলেন, প্রতিটি দুর্ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা হচ্ছে, তবে এসব মামলার রিপোর্ট পেয়ে পুলিশ তদন্তে নামে। লাইনে হত্যা মামলা উদ্ঘাটনে রেলপুলিশ দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। তবে এ পথকে নিরাপদ করতে হলে যথাযথ জনবল জরুরি।

রেলওয়ে সদর দফতর সূত্র জানায়, চলতি বছরের ১৯ আগস্ট কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে একটি পরিত্যক্ত বগিতে আসমা (১৭) নামে এক কিশোরীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ১০ এপ্রিল রাজধানীর খিলগাঁও রেললাইনের ওপর গলাকাটা ৮ বছর বয়সী এক ছেলের লাশ পাওয়া যায়।

পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে নাজমুল হোসেন নামে ওই শিশুকে হত্যা করে লাশ রেললাইনে ফেলা হয়। ২৫ জানুয়ারি আশকোনা ও কাওলার মধ্যবর্তী স্থানের রেললাইনের পাশে সাবরেজিস্ট্রার মাহবুব আলমের লাশ পাওয়া যায়। পুলিশের দাবি, ট্রেনের ধাক্কায় তার মৃত্যু হয়েছে।

তবে পরিবার অভিযোগ করেন, পেশাগত বিরোধের জেরে তাকে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনার আগের রাত থেকে তিনি নিখোঁজ ছিলেন। একইভাবে ১ ফেব্রুয়ারি সকালে একই এলাকার রেললাইনে নীলকান্তি রায়ের লাশ পাওয়া যায়। তার মৃত্যুর রহস্য এখনও উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি।

২০১৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনে বস্তাবন্দি এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়। ২২ মার্চ মগবাজার রেললাইনে গলাকাটা লাশ পাওয়া যায়। ৩০ মার্চ সাকিব খান নামে এক ছেলের লাশ উদ্ধার হয় বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন আউটার থেকে।

১৫ জুলাই লালমনি এক্সপ্রেসে ট্রেনের ছাদে অজ্ঞাতপরিচয় লাশ পাওয়া যায়। ১৫ আগস্ট টাঙ্গাইল কালিহাতী রেললাইনে গলাকাটা লাশ উদ্ধার হয়। একই দিন আরেক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয় টাঙ্গাইলের কালিহাতীর রাজবাড়ী রেললাইন থেকে। ১০ ডিসেম্বর বনানী রেললাইন থেকে মোস্তফা নামে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার হয়। ২৮ ডিসেম্বর ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট রেললাইনের পাশে মাথা-হাত-পা আলাদাসহ এক মহিলার লাশ উদ্ধার হয়।

রেলওয়ে পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, অরক্ষিত রেলপথের ৯৮ শতাংশ রাতে অন্ধকারে ঢাকা থাকে, অনেক এলাকা থাকে নির্জন। এ পথে কোনো অপরাধী যদি কাউকে হত্যা করে লাইনে ফেলে যায়, রেলওয়ে পুলিশের কী করার আছে। তাছাড়া রেলপুলিশে লোকবলের অভাব যুগ যুগ ধরেই রয়েছে।

তিনি বলেন, যেসব লাশ উদ্ধার করা হয়, সেগুলোর ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পেতেও দীর্ঘ সময় লেগে যায়। ফলে মৃত্যুর মূল রহস্য উদ্ঘাটন করতেও লেগে যায় বছরের পর বছর। তিনি অভিযোগ করেন, তাছাড়া রেললাইনে উদ্ধার হওয়া লাশের গুরুত্ব দেন না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পুলিশ প্রশাসন থেকে কিছু কিছু লাশ হিমাগারে রাখার অনুরোধ থাকলেও আজ পর্যন্ত রাখার নজির নেই।

সংশ্লিষ্টরা জানান, রেল আইনের ১২ নম্বর ধারা অনুযায়ী, রেললাইনের দুই পাশে ২০ ফুটের মধ্যে নির্দিষ্ট লোক ছাড়া কেউ অবস্থান করতে পারবে না। লাইনের দুই পাশের ২০ ফুট এলাকায় সব সময় ১৪৪ ধারা জারি থাকে। ওই সীমানার ভেতর কাউকে পাওয়া গেলে গ্রেফতারের বিধানও রয়েছে।

কিন্তু জনবহুল দেশ হিসেবে বাস্তব কারণেই এজন্য কাউকে আটকের উদাহরণ নেই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ জানান, রেললাইন থেকে উদ্ধার হওয়া লাশের ময়নাতদন্তে হত্যার আলামত পাওয়া খুবই কঠিন।

কারণ লাশের অবস্থা এমন হয়ে যায়, সেখান থেকে খুনের আলামত সংক্রান্ত কোনো কিছু উদ্ধার করা যায় না। পরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, এসব মৃত্যু রোধে রেলওয়ের কিছু বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। পুরো রেলেই ফাইবার অ্যাপটিক্যাল রয়েছে। রেলওয়ে সংশ্লিষ্টরা চাইলে পুরো রেলপথ না হলেও চিহ্নিত জায়গাগুলোয় সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে পারেন।

এতে শুধু হত্যাকাণ্ডই শনাক্ত হবে না, ট্রেন অপারেশন করতে গিয়ে কী কী সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, তা-ও চিহ্নিত হবে। তিনি বলেন, উন্নত রাষ্ট্রেও রেললাইনে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। তবে আমাদের রেলপথ একেবারেই অনিরাপদ-উন্মুক্ত। ফলে এখানে অপরাধীরাও সহজে পার পেয়ে যায়।
সূত্র: যুগান্তর


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply