সিনেমায়-নাটকে হারিয়ে যাচ্ছে শুদ্ধ বাংলার ব্যবহার!

|

বিজ্ঞরা বলেন, যে কোনো সংস্কৃতিচর্চার জন্য ভাষা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ভাষার অপপ্রয়োগে অধঃপতন হতে পারে অনেক শক্ত ও মজবুত শিল্পেরও। সেই অধঃপতনের দিকেই যেন হাঁটছে এ দেশের সিনেমা শিল্প! সত্তর থেকে নব্বই দশকে ঢাকাই ছবিতে ভাষার যে শাণিত উচ্চারণ ও আবেদন ছিল, কালক্রমে তা হারিয়ে গেছে। সেখানে দখল নিয়েছে আঞ্চলিক ভাষাগুলো। সেগুলোও উঠে আসছে ভুল উচ্চারণ ও অর্থ নিয়ে। নানা দোহাই ও অজুহাতে ঠাঁই পাচ্ছে অশ্লীল সংলাপও।

ছবি বাজারের এ রোগ নাটকে আরও প্রকট। আজকাল বাস্তবতার দোহাই দিয়ে জাঁকজমক আয়োজনে মানহীন গল্প ও সংলাপে নাটক নির্মিত হচ্ছে। সেখানে বিকৃত ভাষা স্থান পাচ্ছে। সাময়িকভাবে মানুষ সেটা লুফে নিলেও তা কিন্তু টিকছে না। সে কারণে কখনও বরিশাল, কখনও ময়মনসিংহ, কখনও পুরান ঢাকা, কখনও বা নোয়াখালীর ভাষার ওপর দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে। কোথাও থিতু হওয়া যাচ্ছে না। আরও একটি বেদনার বিষয় হল, ভাষাকে বিনোদনের মসলাদার হাতিয়ার বানিয়ে অনেক সময় বিভিন্ন ভাষার সংমিশ্রণ ঘটানো হচ্ছে নাটকে।

বিষয়টি নিয়ে জনপ্রিয় অভিনেতা ও নির্মাতা তৌকীর আহমেদ বলেন, ‘এ নিয়ে বেশি কিছু বলতে চাই না। এই অশুদ্ধ চর্চা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, এ প্রজন্মের অনেকেই সেটা নিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলছেন। শুধু সচেতনতার অভাব নাটক কিংবা সিনেমায় বাংলা ভাষাটাকে প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। রেডিও থেকে শুরু করে টেলিভিশন, ওয়েব মাধ্যম- সব জায়গাতেই অশুদ্ধ ব্যাকরণে ভরে গেছে। স্ক্রিপ্টে আঞ্চলিকতার ব্যবহার দোষের কিছু নয়। এটা একটা নির্দিষ্ট গল্পের জন্য থাকে। তবে সেখানেও খেয়াল রাখতে হবে অশ্লীল বা অশুদ্ধ সংলাপ যেন না থাকে। শেষ কথা, সেন্সর বোর্ড, টিভি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ, স্ক্রিপ্ট রাইটার ও নির্মাতারা একটু সচেতন থাকলে হয়তো এর সমাধান হলেও হতে পারে।’

তবে সিনেমায় পুরোপুরি শুদ্ধ ভাষা ব্যবহারের পক্ষেও নন চিত্রপরিচালক কাজী হায়াত। তিনি বলেন, “সাহিত্য, সিনেমা, নাটক, যাত্রা- এ চারটি বিষয়ে আলাদা আলাদা ভাষা ব্যবহার হয়। সিনেমা হচ্ছে ছায়াবাণী। ছায়া হচ্ছে বাস্তবতা আর বাণী হল তার বলাটা। সব মিলিয়ে বলা যায় সিনেমা হচ্ছে জীবনের ছায়াবাণী। সিনেমা কখনও শুদ্ধ ভাষায় চলতে পারে না। যেমনটা হচ্ছে- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা শরৎচন্দ্রের সাহিত্য দিয়ে, সিনেমার ভাষা ব্যবহার করতে পারবেন না। ‘আমি এখন ওপারে কি করিয়া পার হইব’ এটা সম্পূর্ণ শুদ্ধ ভাষা (সাধু ভাষা)। এটা হয়তো ছবিতে চরিত্রের স্বার্থে কিছু দৃশ্যে ব্যবহার করা যেতে পারে, কিন্তু পুরো সিনেমায় এই শুদ্ধ ভাষা ব্যবহার যোগ হতে পারে না। চরিত্রের জন্য, সঠিক ভাষার ব্যবহার ঠিক রাখতে হবে এবং যথাসময়ে পরিবর্তন করতে হবে। সিনেমার ভাষাটা একদমই আলাদা। এখানে দর্শক হলে ধরে রাখতে হলে যে কোনো ভাষার ব্যবহার রাখতে হবে। কিন্তু তার মানে এই নয়, অশ্লীল ভাষা বা অশুদ্ধ কোনো সংলাপ যোগ করতে হবে। এ বিষয়ে গল্পকার, নির্মাতা, অভিনেতা অভিনেত্রী ও সেন্সর বোর্ড একটু সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে যে ভাষার ব্যবহার সঠিক হচ্ছে কি-না?”

আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়, নাটক বা সিনেমায় যে অঞ্চলের ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছে, সেটাও বিকৃত ভাষা। কারণ কোনো রকম পরীক্ষণ ছাড়াই সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের ভাষা ব্যবহার করে সেটাকে আরও বিরক্তিকর করে তুলছে। যেমন, নাটক বা সিনেমায় নোয়াখালীর ভাষায় কোনো চরিত্রে যে অভিনেতা বা অভিনেত্রী অভিনয় করেন, তিনি নোয়াখালীর ভাষাটা রপ্ত করেন না। এর ফলে ওই অঞ্চলের দু’চারটি শব্দ জুড়ে দিয়ে এমন একটা ভাষা ব্যবহার করে সেটাকে নোয়াখালীর ভাষা বলে চালিয়ে দিচ্ছেন, সেটা একবারেই হাস্যকর। রীতিমতো ওই অঞ্চলের ভাষাটাকে অপমান করাও বটে।

এ প্রসঙ্গে অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী বলেন, ‘আসলে নাটকের ভাষার ব্যবহার কিংবা সংলাপ নিয়ে আমার নতুন করে কিছু বলার নেই। একজন বললেই হবে না। সবাই যদি সম্মিলিতভাবে চেষ্টা না করেন, তবে ভাষার বিকৃতি হতেই থাকবে। এর একটা প্রমাণ মিলবে আজ থেকে এক দশক আগের নাটকগুলো দেখলে। ভাষা বিকৃতি এবং নাটকে উপযুক্ত সংলাপ না পাওয়ার অনেক কারণও আছে। সব কিছুতে এখন অবহেলা, আর যাচ্ছেতাই অবস্থা চলছে। একজন বললে হবে না। সবাই এ সমস্যাগুলোর সমাধানে সচেতন হতে হবে। একটি নাটক থেকে আরেকটি নাটক ভালো করতে হবে এমন চিন্তা করা দরকার নির্মাতা ও শিল্পীদের।’

নাটক-ছবিতে ভাষা প্রয়োগ নিয়ে প্রায় এক যুগ ধরেই বিতর্ক চলছে। যেখানে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর মতে, নাটক বা চলচ্চিত্রে সংলাপের ভাষা কেবল প্রমিতই হবে না, শহুরে কথ্য ভাষাও চলবে। ফারুকী নানা সময়ে এমনও বলেছেন, সংবাদপাঠের মতো অনুষ্ঠানগুলো প্রমিত বাংলাতেই করতে হবে। কিন্তু সিনেমা-নাটকে চরিত্রানুযায়ী অনানুষ্ঠানিক বা কথ্যভাষার ব্যবহার হওয়াটা দোষের কিছু হতে পারে না।

ফারুকীর মতবাদ মেনে নিলে বলতে হয়, নাটকে যখন কোনো অভিনেতা ‘তুমি কোথায়’-এর জায়গায় ‘তুমি কই’ বলেন, সেটা নিশ্চয়ই শুনতে ভালো দেখায় না এবং সঠিক অর্থও বহন করে না। কিংবা সেটা স্ক্রিপ্টের দোহাই দিয়ে জায়েজও করা যায় না।

কলকাতার নাটক সিনেমার প্রতি এখনও এ দেশের মানুষের টান রয়েছে। এর কারণ হিসেবে অনেকেই মনে করেন, ওদের ভাষাটা মুগ্ধ করে। শুদ্ধ উচ্চারণে বাংলা বলে তারা। তবে তার মধ্যে তো অবশ্যই কলকাতার টান থাকে। কিন্তু ওরা উচ্চারণে জোর দেয়। প্রমিত ভাষাটাকে গুরুত্ব দেয়। যেটা একটা সময় আমাদের নাটক-সিনেমার বিরাট গুণ ছিল। খান আতাউর রহমান, হুমায়ূন আহমেদ, আহমদ জামান চৌধুরী, মমতাজউদ্দীন আহমদের মতো বিখ্যাত চিত্রনাট্যকাররা সাফল্যের সঙ্গে ভাষার সুন্দর প্রয়োগ ঘটাতেন। কিন্তু দিনে দিনে ভাষার ‘স্মার্টনিটি’ কেটে গেছে। এখন যে যেখানে যেমন ইচ্ছা শব্দ ব্যবহার করে সংলাপ লিখছেন। আর শিল্পীরা সেগুলো ধারণ করে দর্শকের কাছে তুলে দিচ্ছেন।

শুদ্ধ ভাষাটা মান ধরে রাখে। দর্শকের মনও ধরে রাখে। সে ভাষাটা আর যাই হোক কারও খারাপ লাগে না। কিন্তু ‘আইছি’, ‘গেছি’ টাইপ ভাষা নাটক-সিনেমাকে কদর্য করে। নাটকের তো কোনো সেন্সর বোর্ড নেই। তবে যারা বিভিন্ন চ্যানেলে ও ইউটিউব চ্যানেলে নাটক বাছাইয়ের দায়িত্ব পালন করছেন তারা একটু সতর্ক ও রুচিশীল হলেই নাটকে অবান্তর ও বহুমিশ্রণের ভাষা প্রয়োগ থেকে বেঁচে যাবে দেশীয় নাটক। দর্শক বাঁচবে বিরক্তি থেকে।

আর চলচ্চিত্রের ভাষাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সেন্সর বোর্ডকে আরও সতর্ক হওয়া উচিত। সেই সঙ্গে তথ্য মন্ত্রণালয়কেও এ ব্যাপারে মনযোগী হওয়া উচিত বলে মত দিয়েছেন চলচ্চিত্র বিশ্লেষকরা।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply