রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কাছে অর্থ পাচারের তথ্য চায় মন্ত্রণালয়

|

অর্থ পাচারের তথ্য দেয়ার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ব্যাংকের মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার হয়েছে কি না- এ সংক্রান্ত তথ্য অর্থ মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে বলা হয়।

ব্যাংক ঋণের সঙ্গে সম্পর্কিত ঠিকানায় স্থাপনা ও প্রকল্পের অস্তিত্ব জানতে সরেজমিন পরিদর্শনের নির্দেশ দেয়া হয় ছয় ব্যাংককে। পাশাপাশি সন্তানসন্ততি বিদেশে বসবাস করছে- এমন পরিবারকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক করা হয়।

এছাড়া ব্যাংকগুলোকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে মানি লন্ডারিংয়ের ব্যাপারেও। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) এসব নির্দেশ দিয়েছেন। বৈঠকের কার্যবিবরণী সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

সূত্র আরও জানায়, অর্থ পাচারকারীদের শক্তভাবে আইনের আওতায় এনে তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এখন থেকে ব্যাংক ঋণ দেয়ার আগে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নগদ টাকার প্রবাহ কেমন, তা আরও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে বলা হয়।

তবে গ্রাহকদের পুনরায় ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে নগদ টাকার নিরাপত্তা বা জামানত ভালোভাবে গ্রহণ করতে বলা হয়। নির্দেশনায় ব্যাংক ঋণের সুদের হার সরল ও সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে বলা হয়।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত) মইনুল ইসলামের গবেষণায় বলা হয়, প্রতিবছর দেশ থেকে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। এই অর্থের একটি অংশ আসছে ব্যাংক লুটের মাধ্যমে।

অর্থ পাচার প্রসঙ্গে অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, বিত্তবান হওয়ার লোভনীয় ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যাংক ঋণ লুণ্ঠন। প্রতিবছর ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা লুটপাট হচ্ছে।

ব্যাংকিং খাতের শনির দশা কাটতে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণমুক্ত শক্তিশালী ও কঠোর মনিটরিং পদ্ধতি চালু করতে হবে। আর কার্যকর ও দুর্নীতিমুক্ত বিচারব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি শক্তিশালী করতে হবে শেয়ারবাজারকেও।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, অর্থমন্ত্রীর নির্দেশগুলো নীতিবাক্য। ব্যাংকগুলোর প্রতি এসব নির্দেশ থাকতে পারে।

কিন্তু এতে ফলপ্রসূ কোনো কাজ হবে না। ব্যাংকের অনিয়ম সংক্রান্ত ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে একটি করে কেস ধরে অপরাধের জন্য শাস্তি দিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ মানি লন্ডারিংয়ের জন্য একটি, ঋণ জালিয়াতিতে সহায়তার জন্য একটি- এভাবে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে এ ধরনের নীতিবাক্য আগেও হয়েছে, ভবিষতেও হবে; কিন্তু সুফল আসবে না।

জানা গেছে, সম্প্রতি রাষ্ট্রায়ত্ত ৬টি ও বিশেষায়িত ২টি ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন অর্থমন্ত্রী। ওই বৈঠকে প্রতিটি ব্যাংকের অবস্থান তুলে ধরা হয়। বৈঠকে উল্লিখিত বিষয়গুলো তুলে ধরে তা অনুমোদনের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আসাদুল ইসলাম একটি সারসংক্ষেপ পাঠিয়েছেন অর্থমন্ত্রীর কাছে।

ওই সারসংক্ষেপে আসাদুল ইসলাম বলেন, আর্থিক খাতের গতি বৃদ্ধি, ঋণের সুদের হার এক অঙ্কে নিয়ে আসা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা বৃদ্ধি, ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণের পুনঃতফসিলীকরণসহ কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

সূত্র জানায়, ওই বৈঠকে ব্যাংক থেকে অর্থ পাচারের ইস্যু নিয়েও আলোচনা হয়। বৈঠকে অর্থমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট সব ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিদের নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘ব্যাংকের মাধ্যমে দেশ থেকে টাকা পাচার হয়েছে কি না? কত টাকা পাচার হয়েছে, তা দ্রুত জানানোর নির্দেশ দেন।

এছাড়া এলসি খোলার ক্ষেত্রে মেশিন ও মেশিনারি যন্ত্রপাতির যে মূল্য দেখানো হয়, তা বর্তমানে খুব সহজেই অনলাইনে যাচাই করা যায়। তিনি আরও বলেন, প্রতিটি মন্দঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংক কর্মকর্তা ও ঋণগ্রহীতার মধ্যে একটি অনৈতিক সম্পর্ক থাকে এবং কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এসব ঋণ কিছু অসাধু ব্যবসায়ী গ্রহণ করে থাকেন।

অনেক ব্যবসায়ী এ প্রক্রিয়ায় ভুয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে বিপুল অঙ্কের ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করে থাকেন। তিনি ব্যাংক থেকে যাতে কোনো ধরনের মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনা না ঘটে, এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন।

ব্যাংকিং খাতে আশঙ্কাজনক হারে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ রাখতে বেশ কয়েকটি নির্দেশ দেয়া হয়। খেলাপি ঋণ আদায় করতে অর্থমন্ত্রী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডিদের ঋণগ্রহীতাদের স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে আলোচনার পরামর্শ দেন। নন পারফর্মিং লোনের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে বলেন। এছাড়া পুরনো অভিজ্ঞ ব্যবসায়ীদের ব্যাংকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে বলেন।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা। জুন শেষে অবলোপন বাদে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ লাখ ১২ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা।

আর অবলোপনসহ খেলাপি ঋণের পরিমাণ দেড় লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এদিকে অনেক ঋণগ্রহীতা ঋণ নেয়ার পর খেলাপি হয়েছেন। ঋণের ঠিকানায় প্রকল্পগুলোর অস্তিত্ব আছে কি না, কী অবস্থায় প্রকল্পগুলো আছে, বর্তমান এসব প্রকল্প বন্ধ না সচল, তা খতিয়ে দেখা হবে। এজন্য ব্যাংকগুলোকে ঋণের অনুকূলে বিভিন্ন প্রকল্প সরেজমিন পরিদর্শন করতে বলা হয়েছে।

ওই বৈঠকে বেসিক ব্যাংক নিয়ে কিছু দিকনির্দেশনা দেয়া হয়। তবে বেসিক ব্যাংকের এমডি রফিকুল আলম অর্থমন্ত্রীকে জানান, ব্যাংকের বর্তমান আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। এনপিএল (নন পারফর্মিং লোন) ৬০ শতাংশ।

তবে ৬ মাসের মধ্যে তা ২০ শতাংশে নামিয়ে আনার একটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বর্তমানে ব্যাংকটিতে ৩৩টি লোকসানি শাখা রয়েছে, যা ৬ মাসের মধ্যে ২৩টিতে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে জানানো হয়।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply