বিলম্বিত পদ্মা সেতুর সর্বশেষ অবস্থা

|

মাহমুদুল হাসান,মুন্সিগন্জঃ

পদ্মা সেতু বাংলাদেশের পদ্মা নদীর উপর নির্মাণাধীন একটি বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু। এর মাধ্যমে মুন্সিগঞ্জের সাথে শরিয়তপুর ও মাদারীপুর যুক্ত হবে, ফলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের সাথে উত্তর-পূর্ব অংশের সংযোগ ঘটবে।

বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য পদ্মা সেতু হতে যাচ্ছে এর ইতিহাসের একটি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং নির্মাণ প্রকল্প। দুই স্তর বিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাস ব্রিজটির ওপরের স্তরে থাকবে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরটিতে থাকবে একটি একক রেলপথ। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর অববাহিকায় নির্মিত হচ্ছে দেশটির সবচেয়ে বড় সেতু। সরকারের পরিকল্পনা মাফিক ২০১৮ সালের শেষের দিকে এটি যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার কথা থাকলেও তা হয় নি।

তবে ২০২০ সালের মধ্যে পদ্মা সেতুর কাজ শেষ করার জন্য ঠিকাদারকে সময় বেধে দিয়েছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ)। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মেয়াদ শেষ হয়। এরপর কতো সময় বাড়ানো হবে তা নিয়ে চলে বৈঠক আর আলোচনা। এ.ই.সি.ও.এম এর নকশায় ২০১৪ সালের ৭ ই ডিসেম্বরে সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি)।

রোববার (১৮ আগস্ট) চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিকে (এমবিইসি) আনুষ্ঠানিকভাবে সময়সীমার ব্যাপারে জানানো হয়েছে। এছাড়া নদী শাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো কর্পোরেশন।

এগিয়ে চলছে রোডওয়ে ও রেলওয়ে স্লাব তৈরির কাজ। পুরো সেতুতে ২ হাজার ৯৩১টি রোডওয়ে স্ল্যাব বসানো হবে। আর রেলওয়ে স্ল্যাব বসানো হবে ২ হাজার ৯৫৯টি। জাজিরা প্রান্তে সেতুর ভায়াডাক্টে (সেতুর গোড়া) রোডওয়ে স্ল্যাব বসানোর কাজ চলছে। ইতোমধ্যে জাজিরা প্রান্তে এ পর্যন্ত ৩৯টি রোডওয়ে স্ল্যাব ও ৩২২টি রেলওয়ে স্ল্যাব বসানো হয়েছে। জাজিরা প্রান্তে এ পর্যন্ত ১০টি ‘সুপার টি’ উঠানো হয়েছে। বাকিগুলো উঠানোর কাজ চলছে। জাজিরা প্রান্তে ২৩৪টি ‘টি-গার্ডার’ বসানো হবে। মাওয়া প্রান্তে ২০৪টি ‘টি-গার্ডার’ বসানো হবে।

পদ্মা সেতুতে নদীতে বিদ্যুৎ বিভাগের ৭টা খুঁটি বসানোর কাজ এগিয়ে চলেছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের সঙ্গে এই বিদ্যুতের লাইন স্থাপনের চুক্তি হয়। জাজিরা প্রান্তে বিদ্যুতের ৭নং খুঁটিতে পাইলিং শুরু হয়েছে। ৭ খুঁটিতে মোট পাইল বসবে ৩৬টি। ইতোমধ্যে ২টা পাইলের বটম সেকশনের টাওয়ার ৭ ও টাওয়ার ৮ এর কাজ হয়েছে। পদ্মা সেতুর ২৪০০ এবং ৩৫০০ কিলোজুল ক্ষমতার হ্যামার দুটি এ পাইলিংয়ের কাজ করছে।

৪২টি পিলারের ওপর ৪১টি স্প্যানে গড়ে উঠবে পুরো পদ্মা সেতু। পদ্মার বুকে ৪২টি পিলারের মাথা তুলে দাঁড়ানোর দৃশ্য দেখতে সময় লাগবে আরও ৮ মাস। কাজ শুরু করতে গিয়ে ১১টি পিলারের পাইলিং নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়। এক বছরের বেশি সময় ধরে আটকে থাকে এসব পিলারের কাজ।

নদীর তলদেশে মাটির গুনাগুনগত বৈচিত্র্যের কারণে এসব পিলারের নকশার অপেক্ষায় থাকে ঠিকাদার। এরপর থেকেই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেতুর কাজ সম্পন্ন করা নিয়ে দেখা দেয় সংশয়। নকশা সমাধান হয়ে চূড়ান্ত হলে এরপর কাজ শুরু হয়। এসব পিলার সম্পন্ন হলে মূল সেতুর সব পিলারের কাজও শেষ হবে। ১১টি পিলারের কাজ ২০২০ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা আছে প্রকৌশলীদের। জানা যায়, সর্বশেষ চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে পদ্মা সেতুর ৬ ও ৭ নম্বর পিলারের নকশা সমাধানের মাধ্যমে শেষ হয় নকশা জটিলতা। এর আগে, ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি সেতুর ৮, ১০, ১১, ২৬, ২৭ নম্বর পিলারের নকশা চূড়ান্ত অনুমোদন হয় ও অক্টোবর মাসের শেষের দিকে চূড়ান্ত হয় ২৯, ৩০, ৩১ ও ৩২ নম্বর পিলারের নকশা।

চলতি বছরের জুলাই মাসে শেষ হয় পদ্মা সেতুর সব পিলারের পাইল ড্রাইভিংয়ের কাজ। সেতুর মোট ৪২টি পিলারের মধ্যে প্রস্তুত ৩১টি পিলার এবং বাকি ১১টি পিলারের কাজ চলমান আছে। ৪১টি স্প্যানের মধ্যে ১৪টি স্প্যান বসানোর মাধ্যমে দৃশ্যমান হয়েছে ২১০০ মিটার (২.১ কিলোমিটার)। ডিজাইন অনুযায়ী সেতুর পিলারগুলো ৮ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল।

৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ বহুমুখী সেতুর মূল আকৃতি হবে দোতলা। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে এ সেতুর কাঠামো। এছাড়া পদ্মা সেতুর দুইপ্রান্তেই চলছে প্রায় ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সংযোগ সেতুর (ভায়াডাক্ট) কাজ। সেতু নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা।

পদ্মা সেতুর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বিতর্ক সবসময়ই ছিল। কিছুদিন যাবত পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজের জন্য মানুষের মাথা লাগবে বলে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়েছে,যা জনমনে ব্যাপক আতংক সৃষ্টি করে। তবে তার বিরুদ্ধে সতর্ক করে দিয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষ। এছাড়া কোনও এলাকার আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকেই কোনও অপহরণের খবর পাওয়া যায়নি।

আশা করা হচ্ছে ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসের মধ্যে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচলের উপযোগী করতে পারবে।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply